শেয়ারবাজারে আসার নাম করে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করেছিল বস্ত্র খাতের কোম্পানি রয়েল ডেনিম লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি খুব শিগগির শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে ৪০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে। পরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির আবেদনই করেনি প্রতিষ্ঠানটি, আবার বছরের পর বছর প্লেসমেন্টধারী বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশও দেয়নি।
এখন অনেকটা আড়ালে রয়েছে কোম্পানিটি। নেই প্লেসমেন্টধারীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ। ফলে যারা প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনেছিলেন তারা বিপাকে পড়েছেন। এখন তারা না পাচ্ছেন প্লেসমেন্টের টাকা ফেরত, না পাচ্ছেন লভ্যাংশ। ফলে প্লেসমেন্ট শেয়ার এখন তাদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববাজারে ডেনিম কাপড়ে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড। প্রধানত সাশ্রয়ী দাম আর গুণগত মানে সেরা হওয়ায় বাংলাদেশের ডেনিম পোশাকের জনপ্রিয়তা অনেক। ডেনিম খাতকে এগিয়ে নিতে পারলে বছরে ৭০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। বিশ্বে ডেনিমের বাজার প্রায় পাঁচ হাজার ৬২০ কোটি ডলারের। প্রতিবছর বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ ডেনিম পণ্য রপ্তানি করে ৩৫০ কোটি ডলারের, যে কারণে ডেনিমের প্লেসমেন্ট শেয়ারের চাহিদাও বেশি। মূলত এ সুযোগটি কাজে লাগায় রয়েল ডেনিম। সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয় তারা।
জানা গেছে ২০১৩-১৪ সালে এই কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে। তখন প্লেসমেন্টধারীদের বলা হয় কোম্পানির আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো এবং অচিরেই কোম্পানিটি তালিকাভুক্ত হবে। কর্তৃপক্ষের এ ধরনের প্রচারণায় অনেকেই প্লেসমেন্টে আগ্রহী হন। জানা যায়, মোট অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে কোম্পানিটি কৌশল অবলম্বন করে।
প্লেসমেন্ট শেয়ার পাওয়ার জন্য সাধারণত গ্রাহকদের উচ্চমূল্য দিতে হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাজারে শেয়ার যে দরে লেনদেন শুরু হবে (সাধারণত অভিহিত দর বা ১০ টাকা) প্লেসমেন্ট শেয়ার পেতে গ্রাহককে এর বাড়তি অর্থ গুনতে হয়। কিন্তু এ কোম্পানিটি গ্রাহকদের ১০ টাকা দরে শেয়ার বিক্রি করে। যে কারণে এ প্লেসমেন্টের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয় বিনিয়োগকারীরা, এখন যার মাশুল দিতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। প্লেসমেন্টধারীরা বলছেন, ১০ টাকা দরে শেয়ার বিক্রি ছিল কর্তৃপক্ষের প্রতারণার কৌশল।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বস্ত্র খাতের এ কোম্পানিটি ২০১৩ ও ২০১৪ সালে চার কোটি তিন লাখ ৩৭ হাজার ৫০০টি প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে। এসব শেয়ার ফার্র্স্ট সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেড, হেরিটেজ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, রহিমা হোসাইন, পিজুস সাহা, কোম্পানির চেয়ারম্যান এ.এম সাইদুর রহমান, মীর হাসান আলী, মো. আদনান ইমাম, সাদিয়া পারভীন, আফসারউজ্জামান, মো. মিজানুর রহমান, দিপালী চৌধুরীসহ ৬০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে এসব শেয়ার বিক্রি করা হয়। প্রতিটি ১০ টাকা দরে এ শেয়ারের মোট মূল্য দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তখনই কোম্পানিটি পুঁজিবাজার আসবে এমন ঘোষণা দিলেও পরবর্তীকালে কোম্পানিটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এ সময় কিছুদিন কোম্পানিটি বন্ধ ছিল।
এদিকে প্রতিষ্ঠানের সব সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতা ভোগ করলেও প্লেসমেন্টের দায় নিতে চান না প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এ.এম সাইদুর রহমান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করা হয়, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমি এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আসি আরও পরে। সেজন্য এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারব না। আমার জানামতে, কোম্পানির অবস্থা নাজুক থাকার পাশাপাশি কিছু ঝামেলা ছিল। সে কারণে প্লেসমেন্টধারীদের লভ্যাংশ দেয়া হয়নি। এর বেশি কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’
কোম্পানির একটি সূত্র জানায়, ওই সময়ে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু পরে কিছু ঝামেলার জন্য আর আবেদন করা হয়নি। তাছাড়া পুঁজিবাজারে আসার জন্য যেসব শর্ত থাকে, সেখানেও কোম্পানির কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যে কারণে পুঁজিবাজারে আসায় বিষয়টি স্থগিত হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে একজন প্লেসমেন্টধারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোম্পানিটি আমাদের কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করেছিল। কিন্তু পরে কোম্পানিটি পুঁজিবাজারে আসার কোনো চেষ্টাই করেনি। পাশাপাশি তারা আমাদের কোনো লভ্যাংশও দিচ্ছে না। কোম্পানিটির কাছ থেকে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি।’
বস্ত্র খাতের কোম্পানির রয়েল ডেনিম শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। কোম্পানির কারখানা কুমিল্লাতে। কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস আসার আগে কোম্পানিটিতে কিছু সমস্যা ছিল, এখন তা নেই। তিনি জানান, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো। আমাদের ইচ্ছা ছিল প্রতিষ্ঠানটি ভালোভাবে চালু করার পর বিক্রি করে দেব।’
এদিকে কোম্পানির এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে এই কোম্পানির অবস্থা খুব বেশি ভালো নেই, যে কারণে অনেকেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি বলেন, প্রথম দিকে এ প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় কয়েকজন থাকলেও এখন অনেকেই এর মালিক। তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করেছিল, সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ফলে প্লেসমেন্টধারীরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, অনেক কোম্পানিই এ ধরনের প্রতারণা করে। তাই যারা প্লেসমেন্ট নেন, তাদেরই বেশি সচেতন হওয়া দরকার। তারা সচেতন না হলে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য রোধ করা সম্ভব নয়।