গত দুই বছরের মধ্যে শেয়ারের দামে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি আইপিডিসি ফাইন্যান্স। বিশেষ করে গত বছরের এপ্রিলে কোম্পানিটির শেয়ারের দর দুই বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে গেলেও পরে বাড়তে শুরু করে। বাড়তে থাকার ধারাবাহিকতায় শেয়ারদরে উত্থান-পতন হলেও কারসাজির কারণে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা। বিগত সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা, মুনাফা ও আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এর শেয়ারদর সে অনুযায়ী অনেক বেড়েছে। কোনো কোম্পানির শেয়ারদর কোম্পানটির ব্যবসা এবং আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বাড়বে। কিন্তু আইপিডিসির শেয়ারদর এর ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থার ওপর নয়, বরং কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা।
কোম্পারিটির শেয়ারের বাজারচিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে আইপিডিসির শেয়ারের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। এরপর শেয়ারের দর কমে যায়। আবার ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ টাকা ৪০ পয়সায়। একই বছরের জুন মাসে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের কারসাজি। শেয়ারের কারসাজিতে জড়িতদের মধ্যে নাম উঠে আসা একজন হলেন পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত এবং বিমা ও অন্যান্য শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকায় একাধিকবার জরিমানা হওয়া এক বিনিয়োগকারী। সেসময় তার মাধ্যমেই আইপিডিসির শেয়ারে বড় ধরনের কারসাজি হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এতে শেয়ারটির দর সেবছর ৩০ সেপ্টেম্বর বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ টাকা ৬০ পয়সা।
এরপর কারসাজি চক্রের সদস্যরা শেয়ারের দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে বের হয়ে যায়। এতে শেয়ারের দর কমতে থাকে এবং চলতি বছরের ২৮ মার্চ শেয়ারটির দর কমে দাঁড়ায় ৩৪ টাকায়। তবে শেয়ারটির দর খুব বেশি কমতে পারে না, কারণ ঠিক এর পরের কার্যদিবস থেকেই শেয়ারটির দর আবার বাড়তে শুরু করে। কম দামে শেয়ার কিনে আবার কারসাজি শুরু করে সেই একই চক্র এবং এবার এ শেয়ারটির দর ৫ মে এসে দাঁড়ায় ৫৯ টাকায় বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা।
পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, একই মাসে শেয়ারটির দর কমে ৪৫ টাকা ৭০ পয়সায় এলেও কারসাজির কারণে সেই শেয়ারের দর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে গত ২৫ আগস্ট এসে দাঁড়িয়েছে ৭৬ টাকা ২০ পয়সা। এতে এখনো শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি চলছে বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারণ বিগত সময়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া এবং কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা অনুসারে এর শেয়ারের দাম অনেক বেশি। কারণ কোনো কোম্পানির শেয়ারদর এর ভালো ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থান ছাড়াও যদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে এর পেছনে কারসাজি চক্র রয়েছে বলে জানান তারা।
কোম্পানিটির গত দুই বছর ও সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, ২০২০ সালে কোম্পানিটির ব্যবসায় মুনাফা হয়েছে ৭০ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সে সময় কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ১ টাকা ৯০ পয়সা। এরপর ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবসায় মুনাফা হয় ৮৮ কোটি ১০ লাখ ৬০ হাজার টাকা, সে সময় ইপিএস ছিল দুই টাকা ৩৭ পয়সা। ২০২০ ও ২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) ছিল যথাক্রমে ১৬ টাকা ৩৪ পয়সা এবং ১৭ টাকা ১২ পয়সা। সে সময় কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ২০২০ শেষে ২৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং ২০২১ শেষে ৩৮ টাকা ৬০ পয়সা। সে হিসাবে কোম্পানির শেয়ারদর কোম্পানিটির ইপিএস ও এনএভি তুলনায় স্বাভাবিক ছিল বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু কোম্পানিটির সর্বশেষ আথিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায় অর্ধবার্ষিকে কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ১ টাকা ১৯ পয়সা এবং এনএভি দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ১১ পয়সা।
এদিকে গতকাল লেনদেন শেষে কোম্পানির শেয়ারদর দাঁড়ায় ৬৯ টাকা ৫০ পয়সায়। সে হিসাবে কোম্পানিটির ইপিএস ও এনএভি তুলনায় শেয়ারদর অস্বাভাবিক বলে জানান তারা।
কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক দর, কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি না, বা ব্যবসা নিয়ে কোনো তথ্য আসতে যাচ্ছে কি না, যে কারণে শেয়ারদর এভাবে বাড়ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানিটির সচিব সামিউল হাশিম শেয়ার বিজকে বলেন, শেয়ারদর বাড়ার বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই। কোম্পানির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য এবং ব্যবসার বিষয়ে কোনো তথ্য আসার মতো নেই যে কারণে শেয়ারের দাম বাড়তে পারে বলে জানান তিনি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইপিডিসি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে গত বছর থেকে বেশ কারসাজি হয়ে আসছে। এ কারসাজির সাথে পুঁজিবাজারের আলোচিত একজন কারসাজিকারী এবং বাজারসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক লাভবান হতে চায়। যে জন্য কোম্পানিটির শেয়ার একটানা বাড়ছে না। ধাপে ধাপে সময় নিয়ে কমিয়ে আবার বাড়ানো হচ্ছে, যাতে শেয়ারটির দর অনেক বেশি বাড়ানো যায়।
তারা বলছেন, একই খাতের কোম্পানি আরও রয়েছে। আইপিডিসি থেকে ভালো ব্যবসা, ইপিএস এবং এনএভিও আছে। কিন্তু সেই কোম্পানির শেয়ারদর আইপিডিসি থেকে কম কীভাবে হয়। এবং সেই কোম্পানি থেকে আইপিডিসির শেয়ারের মূল্য ২০-২৫ টাকা বেশি। যেখানে আইপিডিসির কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বা ব্যবসা বিষয়ে কোনো তথ্য নেই, যার প্রভাব শেয়ারে পড়তে পারে। তাই আইপিডিসি শেয়ার নিয়ে যে কারসাজি চলছে তা নিশ্চিত করে বলে যায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এসব কারসাজি চক্রকে শনাক্ত করা এবং কারসাজি বন্ধ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাঁচানো। নাহলে এভাবে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বাড়িয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের পথে বসানো হবে এবং বাজারের আস্থা দীর্ঘ মেয়াদে হারিয়ে যাবে বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, আইপিডিসি নিয়ে গত বছর থেকেই কারসাজি চলে আসছে। শেয়ারটির দর নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কারসাজি চলবে বলে কিছু মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। গত বছরের চক্রটিই কারসাজি করছে এই চক্রের সদস্য বাজারসংশ্লিষ্ট অনেকে। এর মধ্যে কিছু ব্রেকারেজ হাউস, একাধিক ব্রোকারেজের কর্মকর্তা এবং ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানান তিনি।