তিন দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংকের পতন হলো যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত এ নিয়ে কড়া বার্তা দিয়ে বললেন, যাঁরা এর জন্য দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংক খাত ও সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে যা যা করণীয়, তার সবই করা হবে।
কিন্তু কিছুই যেন আপাতত হালে পানি পাচ্ছে না। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার জেরে মঙ্গলবার বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে ইউরোপের দেশ স্পেনের স্যানটানডার ও জার্মানির কমার্জ ব্যাংকের শেয়ারদর ১০ শতাংশের বেশি পড়েছে।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর। গতকাল সে দেশের ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন কমেছে ৯০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার কোটি ডলার। এ নিয়ে গত চার দিনে তাদের বাজার মূলধন হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯০ বিলিয়ন বা ১৯ হাজার কোটি ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর মধ্যে আবার সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো। ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের শেয়ারদর ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে। এমনকি সে ব্যাংকে নতুন বিনিয়োগ আসছে, এমন খবরও বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে পারেনি। তবে এ ক্ষেত্রে ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিসের ভূমিকা আছে। কারণ, তারা এ ব্যাংকের ঋণমান হ্রাসের জন্য পর্যালোচনা করছে।
এ ছাড়া ইউরোপের স্টক্স ব্যাংকিং সূচকের পতন হয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ও ক্রেডিট সুসির পতন হয়েছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ায় জাপানের ব্যাংকিং উপসূচক ডটআইবিএনকেএস ডটটির পতন হয়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
এই যখন বাস্তবতা, তখন বাজারে আরেক গুজব সৃষ্টি হয়েছে। সেটা হলো, বাজারের এই অনিশ্চয়তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ হয়তো নীতি সুদহার বৃদ্ধির ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে গিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ও বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। তবে এটা যে আর্থিক ব্যবস্থা ও বিশ্বজুড়ে বাজারের ওপর কতটা চাপ তৈরি করেছে, তার নজির হচ্ছে সিলিকিন ভ্যালি ব্যাংকের বন্ধ হওয়া। নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে প্রবৃদ্ধির চাকা শ্লথ হয়েছে। সেই ধাক্কায় এখন ব্যাংক বন্ধ হচ্ছে। ফলে বিষয়টি গুরুতর রূপ নিয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, ফেডারেল রিজার্ভ যেহেতু এখনো সুদের হার বাড়িয়ে চলেছে, তাই ব্যাংক খাতের ঝুঁকি শেষ হয়ে যায়নি।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের সংকট নিয়ে গবেষণা করে গত বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বেন এস বার্নানকে, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফিলিপ এইচ ডিবভিগ।
আধুনিক কালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট ছিল ১৯৩০-এর দশকের সংকট। ২০২২ সালের নোবেল বিজয়ী বেন বার্নানকে সেই সংকট নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, বিপুলসংখ্যক আমানতকারী একসঙ্গে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়ায় (ব্যাংক রান) ১৯৩০-এর দশকে অর্থনৈতিক সংকট গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
বার্নানকে বলেছেন, স্রেফ গুজবের কারণে যে ব্যাংক ধসে পড়তে পারে, তার বড় নজির এসভিবি।
বিপুলসংখ্যক সঞ্চয়কারী যখন একসঙ্গে সঞ্চয় ভাঙার জন্য ব্যাংকে যান, তখন গুজব কার্যত বাস্তব রূপ লাভের কাছাকাছি চলে যায়। এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়াতে সরকার উদ্ধারকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সেটা হলো, আমানতের বিমা দিয়ে ব্যাংকের জন্য সরকারের আপৎকালীন ব্যাংকার হিসেবে আবির্ভূত হওয়া।
এসভিবির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিক সে কাজটি করেছে।