বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে পরপর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হলেও বিদায়ের পথে থাকা ২০২২ সালে সেই ধারা অব্যাহত থাকেনি। আগের বছরের তুলনায় আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমেছে। এতে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলনেও নেমেছে ধস। গত বছর আইপিও’র মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, এবার প্রায় তার অর্ধেক।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মধ্যে পুঁজিবাজার থেকে ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। ২০২১ সালে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৪টি। প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে অর্থ উত্তোলন করে এক হাজার ২৩৩ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। অর্থাৎ আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে আটটি। অর্থ উত্তোলন কমেছে ৬০৬ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
এর আগে ২০২০ সালে আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ এক হাজার ২৯৬ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বছরটিতে আইপিও’র মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হলেও বছরের শুরুর চিত্র মোটেও ভালো ছিল না। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে এ সময় বন্ধ থাকে শেয়ারবাজারের লেনদেন।
তার আগে ২০১৯ সালে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠে খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেয়। যার ফলে সার্বিকভাবে শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি সমালোচনা হয় কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের আইপিও অনুমোদন নিয়ে। একপর্যায়ে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়ে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল কমিশন সভা করে নতুন আইপিও না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত ৩০ এপ্রিল থেকে আইপিও সংক্রান্ত নতুন কোনো আবেদন নেওয়া হবে না। অবশ্য ওই সিদ্ধান্তের আড়াই মাসের মধ্যে আইপিওতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কোটা বাড়িয়ে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংশোধন আনে বিএসইসি। এরপর দীর্ঘসময় কেটে গেলেও নতুন কোনো আইপিও অনুমোদন দেয়নি খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ফলে ২০২০ সালের প্রথম পাঁচ মাস আইপিও শূন্য থাকে।
তবে মে মাসের শেষদিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আইপিও মার্কেট সরগম হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন একের পর এক প্রতিষ্ঠানের আইপিও দিতে থাকে। ফলে ২০২০ সালে মাত্র সাত মাসেই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পান উদ্যোক্তারা।
২০২০ সালের শেষ দিকে জমজমাট হয়ে ওঠা আইপিও বাজার। ২০২১ সালজুড়েই চাঙা থাকে। ফলে পরপর দুই বছর আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের ঘটনা ঘটে। তবে, বিদায়ের পথে থাকা ২০২২ সালে সেই ধারা দেখা যায়নি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর- এই তিন মাসে চারটি প্রতিষ্ঠান আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করলেও তার আগের আট মাসে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের আইপিও আসে।
চলতি বছর আইপিও’র মাধ্যমে প্রথম কোম্পানি হিসেবে অর্থ উত্তোলন করে জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং। প্রতিষ্ঠানটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৭৪ কোটি ৯৯ লাখ ৯৯ হাজার টাকা উত্তোলন করে। এর মধ্যে প্রিমিয়াম ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ২৭ ফেব্রুয়ারির থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি আইপিও আবেদন নেয়।
এরপর মার্চ ও এপ্রিল মাসে আর কোনো আইপিও আসেনি। দুই মাস বিরতি দেওয়ার পর মে মাসে মেঘনা ইন্স্যুরেন্স আইপিও’র মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। আইপিওতে স্থিরমূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে শেয়ার বিক্রি করে এ কোম্পানিটি ১৬ কোটি টাকা তোলে।
এরপর জুলাই থেকে আগস্ট এ তিন মাসে কোনো আইপিও আসেনি। তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে আইপিও’র মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে দুটি কোম্পানি। এর মধ্যে চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে ১৫ কোটি টাকা এবং নাভানা ফার্মা বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৭৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে নাভানা ফার্মা প্রিমিয়াম পায় ৪৭ কোটি ৮১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।
অক্টোবরে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। স্থিরমূল্য পদ্ধতিতে শেয়ার বিক্রি করে এ ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৪২৫ কোটি টাকা নিয়েছে। চলতি বছর আইপিও’র মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটিই সব থেকে বেশি অর্থ উত্তোলন করেছে। এমনকি বছরটিতে আইপিওতে আসা বাকি ৫টি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একাই তার দ্বিগুণের বেশি অর্থ উত্তোলন করেছে।
চলতি বছর সব শেষ আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছে ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স। স্থির মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে সাধারণ বিমা কোম্পানিটি ২০ কোটি ২৬ লাখ ১১ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছে।
আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কমার কারণ হিসেবে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কমলেও এর আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি আছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর কম আইপিও আসার কারণ এ বছর আইপিও’র জন্য কোম্পানির আবেদন কম পড়েছে।
এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রফিট মার্জিন কমেছে। ফলে কিছু প্রতিষ্ঠান আইপিও’র যেসব শর্তপূরণ করতে হয়, তা পারেনি। আবার বর্তমানে শেয়ারবাজারে কিছুটা তারল্য সংকট রয়েছে। এ কারণেও আইপিও’র সংখ্যা কমেছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের আইপিও প্রসেসিংয়ে আছে। বাজারে তারল্য বাড়লে এসব প্রতিষ্ঠানের আইপিও চলে আসবে- বলেন বিএসইসির মুখপাত্র।