পুঁজিবাজারের প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী সমবায় অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের হিরোর সহযোগীরা সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন পুঁজিবাজারের তালিকভুক্ত আল-আমীন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে। তারা যুক্ত হওয়ার পরপরই গত তিন ডিসেম্বর ফরিদপুরে বিসিক শিল্পনগরীতে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা প্রাঙ্গণে কোম্পানির বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) অনুষ্ঠিত হয়। এ খবরে কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া ও কারসাজি শঙ্কা করছে বাজারসংশ্লিষ্টরা। কারণ কোম্পানির পর্ষদে যারা যুক্ত হয়েছেন তারা সবাই হিরোর ব্যবসায়িক অংশীদার এবং শেয়ার কারসাজির সঙ্গে নানা সময়ে অভিযুক্ত ও সমালোচিত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের মুনাফার বিপরীতে ক্ষতিই বেশি হবে বলে আশঙ্কা করেছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ইজিএমে কোম্পানির দুটি এজেন্ডা অনুমোদন করা হয়। এগুলো হলো অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি টাকায় উন্নীতকরণ ও পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা নির্ধারণ। এজেন্ডা দুটি ইজিএমে শেয়ারহোল্ডাররা অনুমোদন করেছেন বলে কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এর আগে হস্তান্তরের মাধ্যমে কোম্পানির আগের পরিচালকদের কাছ থেকে শেয়ার বুঝে পাওয়ার পর শেয়ার ধারণের বিস্তারিত তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) জানান সাকিব আল হাসান ও হিরোর সহযোগীরা। তথ্য মতে, কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মুন্সি শফিউদ্দীনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমিনুল ইসলাম শিকদারকে কোম্পানির মনোনীত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি ইশাল কমিউনিকেশনের প্রতিনিধি। একই সঙ্গে মাশুক আলম ও এএফএম রফিকুজ্জামানকে পরিচালক এবং জাভেদ এ মতিন, খাইরুল বাশার ও হুমায়ুন কবিরকে মনোনীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং সীমাব ফাহিমকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে কোম্পানির পর্ষদে যুক্ত হওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানিটি ফের চালু করার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। সেই লক্ষ্যে নামমাত্র ব্যবসা শুরু করে শেয়ার নিয়ে বড় কারসাজির পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে খোদ বিএসইসির একটি চক্রও জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া শেয়ার ধারণকারী আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী ও তার সহযোগীদের একাধিকবার শেয়ার কারসাজির কারণে জরিমানা করেছে বিএসইসি। এর মধ্যে মোনার্ক হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন হিরোর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান। তিনি আবার মোনার্ক মার্ট ও মোনার্ক এক্সপ্রেসের একজন পরিচালক।
অন্যদিকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার পোর্টফোলিও ম্যানেজ করছেন হিরো ও তার সহযোগীরা। এর সঙ্গে হিরোর পরিবারের সদস্যরাও জড়িত। তাদের সঙ্গে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে নিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজিকারী জাভেদ এ মতিন। তিনি মোনার্ক মার্টের প্রতিনিধি হিসেবে আল-আমিন কেমিক্যালের পরিচালক হয়েছেন।
জানা গেছে, জাভেদ এ মতিন আন্তর্জাতিক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ ৪০ বছর মার্কিন প্রবাসে থাকা এই ব্যক্তি দুই বছর আগে বাংলাদেশে ফেরেন। মার্কিন পুঁজিবাজারে নিজ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে তিনি ধরা পড়েন। এ জন্য তাকে হাজার কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ২০২০ সালে এক অস্ট্রেলীয় নাগরিকের মালিকানাধীন হংকংয়ের একটি কোম্পানি থেকে প্রতারণার মাধ্যমে এক কোটি ৩৩ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই অর্থই তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাচার করে বাংলাদেশে এনেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে আসার পর জাভেদ পুঁজিবাজারসহ অন্য খাতে অর্থ বিনিয়োগ করেন। তার সঙ্গে এ কাজে অংশীদার হন আবুল খায়ের হিরো ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। তাদের সঙ্গে নিয়ে জাভেদ মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে বাগিয়ে নেন স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজ হাউস লাইসেন্স। পাশাপাশি গড়ে তোলেন ই-কমার্স সাইট মোনার্ক মার্ট, মুন্সীগঞ্জে মোনার্ক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
ইজিএমের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুন্সি শফিউদ্দীন বলেন, ‘ইজিএমে নতুন যুক্ত হওয়া মোনার্ক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মনোনীত সব পরিচালক, স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিলেন। সভায় অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর দুটি এজেন্ডা শেয়ারহোল্ডাররা অনুমোদন করে। ফলে নতুন পরিচালকরা বিনিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানির ব্যবসা শুরু করবেন। পাশাপাশি বিএসইসির দেয়া শর্ত সাপেক্ষে নতুন পরিচালকরা যে বিনিয়োগ করবেন, তা শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসেবে রেখে দেয়া হবে। এর বিপরীতে বিনিয়োগ করা অর্থ পরিশোধিত মূলধন হিসেবে দেখানো হবে।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আল-আমিন কেমিক্যাল ওটিসির মার্কেটের একটি বন্ধ থাকা কোম্পানি। কোম্পানিটি যদি এসএমই মার্কেট আসে, তাহলে যে পরিমাণ কারসাজি হবে, তার থেকে বেশি হবে মূল মার্কেটে। যদি কোম্পানিটি ভালো কোনো গ্রুপ কিনে নিত, তাহলে বিনিয়োগকারীদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু এখন যারা কিনছেন, তাদের হাতে গেলে বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ এসব ব্যক্তি শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত। তারা বলেন, কোম্পানির শেয়ার কারসাজি চক্রের সঙ্গে ডিএসই বা বিএসইসির একটি চক্র জড়িত। সে ক্ষেত্রে বিএসইসির উচিত বিষয়টিতে নজর দেয়া।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান শেয়ার বিজকে বলেন, হিরো ও জাভেদ সংশ্লিষ্টদের বিএসইসি ভালো করে চিনে এবং জানে। এরপরও তাদের একটি কোম্পানি অধিগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যে কোম্পানি কিনা গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে। কিন্তু বেশ কয়েকবার একরকম হয়েছে যে, কোম্পানির উৎপাদন চালুর কথা বলা হলেই কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উৎপাদন চালু তো দূরের কথা, কারখানাই ঠিক নেই। অথচ কারসাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে যাদের একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছে, তাদেরকেই কোম্পানি অধিগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বিষয়টিকে কারসাজির অংশ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। আর বিএসইসি যদি বিষয়টি বুঝেও এ অনুমতি দিয়ে থাকে, তবে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির দায়ভার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, এর আগে আল-আমিন কেমিক্যালের উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাকিবের দুটি প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ ব্যক্তির কাছে শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দেয়া হয়। তবে কোম্পানির সব শেয়ার স্থানান্তর কার্যকর করার পর অবিলম্বে সব শেয়ারকে ইলেকট্রনিক শেয়ারে রূপান্তরিত করতে হবে।
এদিকে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ আশিক ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আতিকা ১৫ দশমিক ৯৭৫ শতাংশ ও তাজাক্কা তানজিম ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ শেয়ার ওই দুই প্রতিষ্ঠান ও পাঁচ ব্যক্তির কাছে বিক্রি করবেন বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, আল-আমিন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে পুঁজিবাজারের ওটিসি একটি তালিকাভুক্ত। সম্প্রতি বিএসইসি ওটিসি মার্কেট বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। তাই আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কোম্পানিটিকে এসএমই প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। কোম্পানিটি ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারসংখ্যা ৫০ লাখ। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে ৫০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৪৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।