দেশের পুঁজিবাজারে খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সি ফুডের শেয়ারের কারসাজিতে যেন নজর নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি)। কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এর এনএভি ৫ টাকা ৭৬ পয়সা হলেও শেয়ারের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫৬১ টাকার বেশি। সেই সঙ্গে কোম্পানির চলতি ২০২১-২২ হিসাব বছরের আয়ে এক ভুতুড়ে হিসাব দেখা যায়। কোম্পানি হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ার প্রতি ৫ টাকার বেশি আয় করলেও তৃতীয় প্রান্তিকে আয় করেছে মাত্র ৪ পয়সা। এদিকে ৯ মাসের ব্যবধানে এনএভি বেড়েছে ৫১৯ শতাংশের বেশি। কোম্পানিটির আয়ে এবং আর্থিক প্রতিবেদন এমন গরমিলে হিসাবকে ‘ভুতুড়ে’ হিসাব বলছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। এ ধরনের হিসাব কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজির কারণেই প্রকাশ করা হয়েছে এবং কারসাতে কোম্পানির যোগসাজশ রয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
কিন্তু এ বিষয়ে বিএসইসির কোনো নজর নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বিএসইসির এরকম নজরবিহীন থাকাকে শেয়ার কারসাজির সুযোগ দেয়া বলে জানিয়েছেন তারা।
কোম্পানিটির শেয়ার ও লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে কোম্পানির শেয়ার দর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। গত বছরে ফ্লোর প্রাইস দেয়ার পর কোম্পানির শেয়ার ১৪৪ টাকা ৩০ পয়সায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করে। এরপর ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয়া হলে শেয়ারটির দর কারসাজি চক্র ৭ জুন ১৪১ টাকা ৫০ পয়সায় নামিয়ে আনে এবং পরের দিন থেকে বাড়াতে শুরু করে। এতে ৯ জুন শেয়ার দর বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৪ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর উত্থান-পতনের মাধ্যমে শেয়ারটির দর প্রথমে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ ৫২৮ টাকার উপরে উঠানো হয়। এরপর কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে গেলে শেয়ার দর কমতে থাকে। কিন্তু কারসাজি তখনও শেষ হয়নি শেয়ারটিতে। এরপর আবার কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দর ধীরে ধীরে কমানো-বাড়ানোর মাধ্যমে গতকাল দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে নেয়া হয়। এদিন লেনদেন শেষে শেয়ারটির দর দাঁড়ায় ৫৬১ টাকা ১০ পয়সা।
অপরদিকে লেনদেন চিত্রে দেখা যায়, গত বছরের মে মাসের শুরুতে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন ছিল কয়েকশ এর ঘরে, কিন্তু ২৪ মে এর পর থেকে শেয়ারটির লেনদেন বাড়তে শুরু করে। পরের দিন শেয়ারের লেনদেন হয় ১০ হাজারের বেশি এবং পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে শেয়ার লেনদেন বৃদ্ধি পায়। এতে ২০২১ সালের অক্টোবরের ১১ তারিখ ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪০৩টি শেয়ার লেনদেন হয় এবং চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শেয়ারটি থেকে কারসাজি চক্র বের হয়ে গেলে শেয়ারের লেনদেন আবার তলানিতে নেমে যায়। এর ফলে গত ১৯ জুলাই শেয়ারটির মাত্র ৭ হাজার ৭৮৭টি শেয়ার লেনদেন হয়।
পরে চক্রটি আবার শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি শুরু করলে ফের লেনদেন বাড়তে শুরু করে। এতে ১৭ অক্টোবর শেয়ারটির লেনদেনে হয় ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬১টি। কিন্তু গতকাল শেয়ারটির লেনদেন কমে হয় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮৬৪টি। যেকারণে শেয়ারটি নিয়ে আপাতত কারসাজি শেষ হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি করার ফলে ১৭ অক্টোবর সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে কিন্তু পরের দিনই সেটা কমে ২ লাখের কাছে নেমে আসে। যা কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি করে বের হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় বলে জানান তারা।
এদিকে কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, ২০২০-২১ হিসাব বছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি মুনাফা (ইপিএস) ছিল ৭২ পয়সা এবং শেয়ার প্রতি সম্পদ মূল্য ছিল ৯৩ পয়সা। কিন্তু ২০২১-২২ হিসাব বছরের প্রথম ছয় মাসে এসে কোম্পানটি ইপিএস দেখায় ৫ টাকা ১২ পয়সা, এর মধ্যে প্রথম তিন মাসে ১ টাকা ৫৬ পয়সা ও পরের তিন মাসে ৩ টাকা ৫১ পয়সা ছিল। কিন্তু পরের তিন মাসে এসে কোম্পানিটি ইপিএস দেখায় ৪ পয়সা। তবে ৯ মাসের ব্যবধানে আবার এনএভি ৫১৯ শতাংশের বেশি হিসাবে দেখানো হয়েছে ৫ টাকা ৭৬ পয়সা, যা পুরোটাই সন্দেহজনক এমন শেয়ার কারসাজির যোগসাজশ বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অপরদিকে কোম্পানিটির বিগত আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২০ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকসান ছিল ৯ টাকা ৮৩ পয়সা। এর আগের ২০১৮ ও ২০১৯ হিসাব বছরে যথাক্রমে ইপিএস হয়েছে মাত্র ৭০ ও ৩৭ পয়সা। আর ২০২০ সালে এনএভি ছিল মাত্র ২১ পয়সা।
এদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পক্ষ থেকে কোম্পানিটির কাছে এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চায়। তখন কোম্পানি অস্বাভাবিক শেয়ার দর ও লেনদেন বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই বলে ডিএসইকে জানায়।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেমিনি সি ফুড একটি স্বল্প পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানি এবং এর শেয়ার নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরেই কারসাজি করা হচ্ছে। কোম্পানিটির শেয়ার সংখ্যা কম হওয়ায় কারসাজি সহজে করা যায়। যার ফলে কোম্পানিটির আয়ে কোনো ধারাবাহিকতা না থাকলেও এবং এর সম্পদ অনেক কমে গেলেও শেয়ার কারসাজি বন্ধ হয় না। এদিকে বছরের পর বছর কারসাজি চললেও অজ্ঞাত কারণে বিএসইসি কঠিন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এতে শেয়ারটির দরে প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিক বাড়লেও বিএসইসির যেন নজর নেই সেটাই বোঝা যায়। আর বিএসইসির নজরবিহীন আচরণই কারসাজির সুযোগ করে দেয়। এর কারণে একটি দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দর ৫০০ টাকার উপরে হতে পারে বলে জানান তারা।
বিএসইসির এমন নজরবিহীন আচরণে বিনিয়োগকারী ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে উল্লেখ করে তারা জানান, বাজারে কারসাজির কারণে তারল্য ও লেনদেন বাড়লেও কারসাজি শেষে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিনিয়োগকারীরা। আর এটা হতে দিলে বাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো রাখা তো যাবেই না, বরং এর প্রতি মানুষের আস্থা একেবারেই হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জনিয়েছেন তারা।
এদিকে গরমিলে আর্থিক হিসাব এবং শেয়ারের দর ও লেনদেনের বিষয়ে জানতে চেয়ে কোম্পানিটির সচিব এএফএম নজরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এবং তাকে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ করা হলে প্রথমে সালামের জবাব দেন। পরে সচিবকে জানতে চাওয়া তথ্যের বিষয়ে মেসেজ দিলে সেটা দেখে আর কোনো উত্তর দেননি।