হিরো ও তার সহযোগীরা গত দুই বছরে কারসাজির মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের কোম্পানি আইপিডিসি ফাইন্যান্সের শেয়ারদর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি করেছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইন অনুসারে হিরো ও তার সহযোগীদের শেয়ার কারসাজির কারণে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তথ্য মতে, গত বছরের এপ্রিলে কোম্পানিটির শেয়ারদর দুই বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ অবস্থানে ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে হিরো ও তার সহযোগীরা কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়াতে শুরু করে। এরপর সেই বাড়তে থাকার ধারাবাহিকতায় শেয়ারদরে উত্থান-পতন হলেও কারসাজির কারণে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছায়। এতে দেখা যায়, বিগত সময়ে কোম্পানিটির ব্যবসা, মুনাফা এবং আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এর শেয়ারদর সে অনুযায়ী অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। কোনো কোম্পানির শেয়ারদর কোম্পানটির ব্যবসা এবং আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে বাড়বে।
এদিকে আইপিডিসির শেয়ারদর এর ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থার ওপর নয়, বরং হিরো ও তার সহযোগীদের কারসাজির মাধ্যমে বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি বাজার-সংশ্লিষ্টদের।
কারসাজি ও জরিমানার বিষয়ে বিএসইসির সিদ্ধান্তে জানানো হয়েছে, আইপিডিসির শেয়ার লেনদেনের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯-এর সেকশন ১৭-এর (ই)-এর (২)(৩)(৫) ভঙ্গের কারণে মো. আবুল খায়ের হিরো ও তার সহযোগীদের মোট ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিনেন্স, ১৯৬৯-এর উল্লেখিত উপধারাগুলোয় বলা আছে, কিছু বিষয়ের কারণে শাস্তি দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে, কোনো শেয়ার লেনদেনে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দেয়া। পাশাপাশি কয়েকটি বিও হিসাবের মাধ্যমে শেয়ার লেনদেনে প্রভাবিত করা। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শেয়ার লেনদেনকে প্রভাবিত করতে সিরিজ ট্রেডিং করা এবং প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে ও মূল্য বৃদ্ধিতে নিজেদের মধ্যে লেনদেন করা। এছাড়া সেই শেয়ারের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্যদের কাছে বিক্রি করা।
কোম্পানিটির শেয়ারের বাজার চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত ২০২০ সালের অক্টোবরে আইপিডিসির শেয়ারদর বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০ টাকা ৫০ পয়সায়। এরপর শেয়ারদর কমে, পরে বেড়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দাঁড়ায় ৩৩ টাকা ৪০ পয়সায়। একই বছরের জুনে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের কারসাজি। শেয়ারের কারসাজিতে জড়িতদের মধ্যে নাম উঠে আসে পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত এবং বিমা ও অন্যান্য শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকায় একাধিকবার জরিমানা হওয়া হিরো ও তার সহযোগীদের নাম। সে সময় তাদের মাধ্যমে আইপিডিসির শেয়ারে বড় ধরনের কারসাজি হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এতে শেয়ারটির দর সে বছর সেপ্টেম্বর ৩০ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ টাকা ৬০ পয়সায়। এরপর কারসাজি চক্রের সদস্যরা শেয়ারদর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে অন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে বের হয়ে যায়, এতে শেয়ারদর কমতে থাকে এবং চলতি বছরের ২৮ মার্চ শেয়ারটির দর কমে দাঁড়ায় ৩৪ টাকায়। তবে শেয়ারটির দর কমতে পারে না। কারণ ঠিক এর পরের কার্যদিবস থেকে শেয়ারটির দর আবার বাড়তে শুরু করে। কম দামে শেয়ার কিনে আবার কারসাজি শুরু করেহিরো ও তার সহযোগীরা এবং এবার এই শেয়ারটির দর মে মাসের ৫ তারিখ এসে ৫৯ টাকায় দাঁড়ায়।
পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, একই মাসে শেয়ারটির দর কমে ৪৫ টাকা ৭০ পয়সায় আসলেও কারসাজির কারণে সেই শেয়ারদর দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে গত ২৫ আগস্টে এসে দাঁড়ায় ৭৬ টাকা ২০ পয়সায়। এরপর শেয়ারটির দর সর্বোচ্চ অবস্থানে ওঠার পর বিক্রি শুরু করে কারসাজি চক্র এবং এর পর থেকে দর কমতে শুরু করে। এদিকে শেয়ারটি নিয়ে বড় কারসাজি হয়েছে বলে জানান বাজার-সংশ্লিষ্টরা। কারণ বিগত সময়ে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া এবং কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা অনুসারে এর শেয়ারের দাম তুলনামূলক বেশি। কারণ কোনো কোম্পানির শেয়ারদরের ভালো ব্যবসা ও আর্থিক অবস্থান ছাড়াও যদি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তাহলে এর পেছনে কারসাজি চক্র রয়েছে বলে জানান তারা।
এদিকে কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে দেখা যায়, অর্ধবার্ষিকে কোম্পানির ইপিএস হয়েছে ১ টাকা ১৯ পয়সা এবং এনএভি দাঁড়িয়েছে ১৭ টাকা ১১ পয়সায়। সে হিসাবে কোম্পানিটির ইপিএস ও এনএভি তুলনায় শেয়ারদর ৭৬ টাকার বেশি হওয়া অস্বাভাবিক বলে জানান তারা। গতকাল লেনদেন শেষে কোম্পানির শেয়ারদর দাঁড়ায় ৫৭ টাকা ৬০ পয়সায়।
এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তার এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানা নেই বলে তিনি জানান।
বিএসইসির অপর এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে এ বিষয়ে নিশ্চিত করে শেয়ার বিজকে জানান, আইপিডিসির শেয়ার কারসাজিতে হিরো ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছে কমিশন। যাদের জরিমানা করা হয়েছে তাদের জানানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ মাত্র তো জরিমানা করা হলো, এখন পুরো বিষয়টির ফাইল এনফোর্সমেন্ট বিভাগ থেকে তৈরি করে চিঠি পাঠাতে কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।