ঋণের জালে আটকে পড়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আমান ফিড। ১৩০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এই কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ৩৮৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির মূলধনের প্রায় তিনগুণ ঋণ। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির যে স্থায়ী সম্পদ আছে, ঋণের পরিমাণ তার দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। এরপরও ঋণের পরিমাণ কমেনি, উল্টো সময়ের সঙ্গে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
একদিকে প্রতিষ্ঠানটি ঋণের জালে আটকা পড়েছে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। এমনকি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশনকে (বিএসইসি) মিথ্যা তথ্যও দিয়েছে। যে কারণে কোম্পানিটির সব পরিচালককে ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও করেছে বিএসইসি।
জানা গেছে, ঋণের টাকা পরিশোধ না করায় ২০২০ সালের ৭ আগস্ট আমান ফিডের জমি নিলামে তুলতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে একটি ব্যাংক। ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ঋণ ও সুদসহ আমান ফিডের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ছিল ২৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
পাওনা টাকা আদায়ে ব্যাংক আমান ফিডের জমি নিলামে তোলার উদ্যোগ নিলে আদালতের শরণাপন্ন হয় কোম্পানিটি। গত বছরের জুনে আদালত আমানি ফিডের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিটির জমি নিলামে বিক্রির বিষয়টি আপাতত স্থগিত রয়েছে।
এদিকে ঋণ নিয়ে এমন কেলেঙ্কারির পরও আমান ফিডের ঋণের পরিমাণ কমেনি। বরং সময়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন সমাপ্ত হিসাব বছর শেষে তাদের মোট ঋণের পরিমাণ ৩৮৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৮৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ১৭১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ১৫৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছর কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। ২০২১ সালের জুনের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটির স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১৭৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এক বছর আগে ২০২০ সালের জুনে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুনে ছিল ১৪২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
এছাড়া ২০২১ সালের জুনে কোম্পানিটির দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কারেন্ট পোরশন ২৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এক বছর আগে ২০২০ সালের জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কারেন্ট পোরশন ছিল ১৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের কারেন্ট পোরশন ছিল ১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
এদিকে অস্বাভাবিক ঋণের পাশাপাশি কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ বছর বছর কমতে দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুন শেষে কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এক বছর আগে ২০২০ সালের জুনে স্থায়ী সম্পদ ছিল ১৪৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের জুনে স্থায়ী সম্পদ ছিল ১৫৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ কমেছে।
অন্যভাবে বলা যায়, একদিকে কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে ঋণের পরিমাণ। দুই বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ কমেছে ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বিপরীতে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৭২ কোটি টাকা। এতে স্থায়ী সম্পদের তুলনায় প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ১৪৩ কোটি টাকা স্থায়ী সম্পদের বিপরীতে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৮৫ কোটি টাকা।
২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া আমান ফিড আইপিও’র টাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫ সালে আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে ৭২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। আইপিওর প্রসপেক্টাস অনুসারে অর্থ হাতে পাওয়ার ১৫ মাস বা ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তা ব্যয় করার সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোম্পানিটি আইপিওর অর্থ ব্যয় করতে পারেনি।
২০২০ সালে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান এমএবিএস অ্যান্ড জে পার্টনার্স’র নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আইপিও অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমান ফিডের বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির সেই সময়ের কমিশন কোম্পানিটির প্রত্যেক পরিচালককে ২৫ লাখ টাকা করে জারিমানা করে।
সে সময় বিএসইসি থেকে জানানো হয়, আমান ফিড সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৯৬-এর ১৮ ধরা লঙ্ঘন করেছে। এছাড়া কমিশনের অনুমোদনপত্রের ৪, ৮ ও ৯ নম্বর শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
জানতে যোগাযোগ করা হলে আমান ফিডের কোম্পানি সচিব মাসুদ করিম বলেন, ‘আমি আমান ফিডে নতুন যোগদান করেছি। তাই খোঁজখবর না নিয়ে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না।’
আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষজ্ঞ ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের সম্পদের ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ হওয়া উচিত নয়। ঋণ যদি বেশি হয় এবং কোম্পানি ভালো মুনাফা করতে না পারে, তাহলে ওই কোম্পানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।