নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড দেশের দ্রুত বিকাশমান একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি। বিশেষ করে ২০২০ সালে সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থাপনায় আসার পর থেকে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির ধারায় রয়েছে কোম্পানিটি। গত ৩ বছরে কোম্পানিটি ৩০তম অবস্থান থেকে দেশের ১৬তম বৃহৎ ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। কোম্পানিটি তার ব্যবসার আরও সম্প্রসারণ এবং এর মালিকানায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (5) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে। বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর নিয়ম অনুসারে সম্প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করার জন্য নিলাম (bidding) অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাত্র ২ সেকেন্ডে শেষ হয়ে গেছে এই নিলাম। এটি একদিকে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহের ইঙ্গিত দিচ্ছে, অন্যদিকে এই নিলাম পদ্ধতির ত্রুটি আবারও সবার সামনে তুলে ধরেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করেও নিলামে শেয়ার কিনতে পারেনি। তাই পদ্ধতিটি সংশোধনের দাবি উঠেছে।
নাভানা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও উদ্যোক্তা প্রফেসর ডাক্তার জোনায়েদ শফিক। তিনি জাপান-বাংলাদেশ হাসপাতালসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীতে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান কার্যালয়ে অর্থসূচককে দেওয়া তার একান্ত সাক্ষাতকারে দেশের ওষুধশিল্প খাত ও নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য উঠে এসেছে। এ সময় বিভিন্ন ইনপুট দিয়ে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন কোম্পানির পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং ড. সায়িদ আহমেদ, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মোঃ আবু হোরায়রা, এফসিএ ও কোম্পানি সচিব জয়নুল আবেদিন, এসিএস।
সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন অর্থসূচকের সহযোগী সম্পাদক ইসমত আরা ও স্টাফ রিপোর্টার মাসুম রহমান।
অর্থসূচকঃ দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা কী?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ ওষুধ শিল্প খাত দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় একটি খাত। এই খাত ইতোমধ্যে দেশকে ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। দেশে ওষুধের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করছে দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো। দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও ওষুধ রপ্তানি করা হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে এই রপ্তানির পরিমাণ।
ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফরম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি’র তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে আমাদের ওষুধের বাজারের আকার ছিল ৩০০ কোটি ডলার বা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা (এক ডলারের বিনিময় মূল্য ১০০ টাকা ধরে)। অথচ মাত্র এক যুগ আগেও এই শিল্পের আকার ছিল মাত্র সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।
স্বল্পোন্নত ৪৭টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই ক্যানসারের ওষুধ এবং টিকা ও ইনসুলিনের মত বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্ট উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। অবশ্য বাংলাদেশ শিগগিরই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চলেছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ৫ বছর দেশের ওষুধ খাতে ১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে।
তবে নানা কারণে বর্তমানে ওষুধ শিল্পের অবস্থা তেমন ভাল যাচ্ছে না। দেশীয় ও বৈশ্বিক নানা সমস্যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এই খাতে। তাতে ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি কমেছে। সর্বশেষ বছরে দেশের ওষুধ শিল্পখাত সাড়ে ৪ শতাংশের মতো সংকোচিত হয়েছে। সম্প্রতি পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে গেছে, অন্য দিকে ডলারের বিনিময়মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানির খরচ পড়ছে অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে দেশের ছোট ও মাঝারি কোম্পানিগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যদিও এই সমস্যাকে আমরা সাময়িক মনে করি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান বিশেষ পরিস্থিতির উন্নতি হলে ধীরে ধীরে আমাদের ওষুধ শিল্প খাতও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় নীতিগত সহযোগিতা না পেলে অনেক ছোট ও মাঝারি ওষুধ কোম্পানির পক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখা বেশ কঠিন হবে। এ বাস্তবতায় ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে ভর্তুকি দেওয়া অথবা ওষুধের দাম কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাড়ানো জরুরি।
অর্থসূচকঃ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, আমাদের দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে এর কোনো প্রভাব আছে কী?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ নানা পণ্যের সাপ্লাইচেইন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তাতে জ্বালানী তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। বেড়েছে পণ্য পরিবহণের ভাড়া। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে।
অন্যান্য পণ্যের মতো ওষুধের কাঁচামালের দাম এবং তার পরিবহণ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। এতে বেড়েছে ওষুধ উৎপাদনের ব্যয়। কিন্তু ওষুধের দাম সেভাবে সমন্বয় করতে না পারায় কোম্পানিগুলোকে কোনো কোনো ওষুধের ক্ষেত্রে লোকসানে পড়তে হচ্ছে।
অর্থসূচকঃ এই শিল্পের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের ওষুধের প্রায় শতভাগ চাহিদা পূরণের সক্ষমতা অর্জন করেছে এই শিল্প খাত। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নেরএই ধারা বজায় থাকলে ওষুধশিল্পের অভ্যন্তরীন বাজার দ্রুত বড় হতে থাকবে। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে জিডিপি যে হারে বাড়ে, তার দ্বিগুণ হারে বাড়ে ওষুধের বাজারের আকার। কারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বাড়লে সে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার প্রতি আরও মনোযোগী হয়। আমাদের দেশে গত প্রায় এক দশক ধরে ছয় শতাংশের বেশি হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই ধারা বজায় থাকলে আগামী দিনগুলোতে বছরে ওষুধের বাজার বাড়বে ১২ শতাংশ হারে।
স্থানীয় বাজারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে দেশের ওষুধ শিল্পের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত ও অতি সুরক্ষিত বাজারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। প্রতি বছরই ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। বলা যায়, তৈরি পোশাকের মতোই বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে ওষুধ শিল্প খাতে।
তবে ওষুধ শিল্প খাতে চ্যালেঞ্জও কম নয়। প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে-ওষুধ উৎপাদনের মৌলিক কাঁচামালের ক্ষেত্রে (Active Pharmaceutical Ingredient-API) আমরা প্রায় শতভাগ আমদানি নির্ভর। এই খাতে সরবরাহ শৃঙ্খল (Supply Chain) ব্যাহত হলে দেশীয় ওষুধ শিল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলারের মূল্যের অস্থিরতাও ওষুধ শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
অর্থসূচকঃ আমাদের ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। রপ্তানি বাজারে আরও ভাল করার কতটুকু সুযোগ আছে? ওষুধ রপ্তানির গতি বাড়াতে বিশেষ কোনো নীতিসহায়তা প্রয়োজন আছে কী?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনা সীমাহীন। এই শিল্প অনেক সংবেদনশীল, উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন ও পুঁজিঘন। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বেশির দেশের এই শিল্পে তেমন কোনো সক্ষমতা নেই। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোতে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। এদিক থেকে বাংলাদেশ খুবই ভাল একটি অবস্থানে আছে। আমাদের দেশের বেশ কিছু কোম্পানির অবকাঠামো (Infrastructure) ও উৎপাদন সুবিধা (Production Facilities) আন্তর্জাতিক মানের। বেশিরভাগ কোম্পানি (Good manufacturing practice-GMP) পণ্য উৎপাদনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান অনুসরণ করে থাকে। অন্যদিকে আমাদের এখানে শ্রমিকের মজুরি প্রতিযোগিতামূলক। ফলে ওষুধের উৎপাদন ব্যয় পড়ে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কম। সব মিলিয়ে ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের একটি অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অষ্ট্রেলিয়ার মত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত বাজারে। বাংলাদেশের কয়েকটি কোম্পানি এসব বাজারেও পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। একাধিক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ (Food and Drug Administration-FDA), যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ (Medicines and Healthcare products Regulatory Agency-MHRA) ও অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ (Therapeutic Goods Administration-TGA) এর অনুমোদন পেয়েছে। আরও কয়েকটি কোম্পানি এসব অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
ওষুধ শিল্পের যে সম্ভাবনা আছে, সে সম্ভাবনা এখনো আমরা কাজে লাগাতে পারিনি-এটা ঠিক। তবে আমাদের চলার গতি কিন্তু বেড়েছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আমরা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উন্নত দেশসহ বিশ্বের ১৬২টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছি।
ওষুধ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। ওষুধ খুবই স্পর্শকাতর একটি পণ্য। উৎপাদক দেশ সম্পর্কে যদি ভাল ধারণা না থাকে, তাহলে ক্রেতারা সে দেশের কোনো কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ কিনতে চান না, ওই ওষুধের মান যত ভাল-ই হোক না কেন। তাই দেশের ব্র্যান্ডিং তথা ভাবমূর্তি উন্নয়নে আরও বেশী মনোযোগ দেওয়া দরকার। অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোর বাজারে ওষুধ বিক্রির অনুমোদন প্রক্রিয়া ও প্রমোশন অনেক ব্যয় বহুল। এসব ক্ষেত্রে সরকার নানাভাবে সহায়তা দিতে পারে।
অর্থসূচকঃ আমরা অনেক দিন ধরে ওষুধ শিল্প খাতে আয় বাড়াতে কন্ট্রাক্ট প্রোডাকশনের সম্ভাবনার কথা শুনে আছি। কিন্তু এখানে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না কেন?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, কন্ট্রাক্টে বিদেশী কোম্পানির ওষুধ তৈরি করে দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করার সুযোগ আমাদের রয়েছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি না হওয়ার কারণ, দেশের বড় কোম্পানিগুলো নিজেদের ওষুধ উৎপাদন করেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। কোনো কোনো কোম্পানি নিজেদের কারখানায় উৎপাদনের মাধ্যমে বাজারের চাহিদা পূরণ করতে না পেরে অন্য কোম্পানির কারখানা ভাড়া নিয়েছে।
অর্থসূচকঃ আমাদের ওষুধ শিল্পের বেশিরভাগ মৌলিক কাঁচামাল (এপিআই) বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাতে ওষুধ উৎপাদনে খরচ বেশি পড়ে বলে অনেক উদ্যোক্তার অভিযোগ। কেন দেশে এপিআই শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না বলে মনে করেন?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ দেশে এপিআই শিল্পের একেবারেই বিকাশ হচ্ছে না, এটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। কয়েকটি কোম্পানি সীমিত পরিসরে এপিআই উৎপাদন করছে। সরকার এই খাতে প্রমোট করতে মুন্সীগঞ্জ জেলায় একটি এপিআই পার্ক স্থাপন করছে। সেখানে ৪২টি কোম্পানিকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি চালু হলে হয়তো, পরিস্থিতির আরও কিছুটা উন্নতি হবে।
তবে এপিআই খাতে বাংলাদেশের বেশিদূর যাওয়া বেশ কঠিন। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ আছে। প্রথমত: এপিআই অনেক বেশি উচ্চ প্রযুক্তি ও পুঁজিঘন শিল্প। শুধু দেশীয় বাজারের চাহিদাকে টার্গেট করে এখানে এত বড় বিনিয়োগ করলে তা লাভজনক না-ও হতে পারে। দ্বিতীয়ত: রপ্তানি তথা আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হলে আমাদেরকে কঠিন প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করতে হবে। এই শিল্প খাতে আমরা অনেক বিলম্বে প্রবেশ করছি। ইতোমধ্যে চীন ও ভারত খাতটিতে জোরালো অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অন্যদিকে এপিআই এরও অনেক মৌলিক কাঁচামাল প্রয়োজন হয়, যেগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। কিন্তু চীন ও ভারতসহ অনেক দেশে সহজলভ্য। এসব মৌলিক কাঁচামাল আমদানি করে এপিআই উৎপাদন করলে উৎপাদন ব্যয় পড়বে চীন ও ভারতের চেয়ে বেশি।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এপিআই যদি আমদানি করা এপিআই এরচেয়ে বেশি হয়, তাহলে দেশীয় এপিআই কেউ কিনবে না। আর কিনলে ওষুধ উৎপাদনের খরচ পড়বে বেশি।
তবে দেশে এপিআই শিল্প গড়ে তোলা একেবারেই অসম্ভব নয়। যদি সরকারের পর্যাপ্ত নীতি সহায়তা থাকে, উদ্যোক্তারা বাজারের উপযোগী কৌশল গ্রহণ করতে পারেন, নিজেদের মধ্যে সমন্বয় থাকে তাহলে হয়তো এই খাতটি ধীরে ধীরে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু নীতি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। এই শিল্পে ২০৩২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন হারে কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে আরও কিছু আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
অর্থসূচকঃ আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চলেছে। এটি হলে অনেক ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা, প্যাটেন্টে ছাড়ের সুবিধা উঠে যাবে। ওষুধ শিল্পে কী এর কোনো প্রভাব পড়তে পারে?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ আপাতত: ওষুধ শিল্পে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) আমাদেরকে প্যাটেন্টের ক্ষেত্রে (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights-TRIPS) যে ছাড় দিয়েছে, সেটি ২০৩২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকার কথা। আর আমরা উন্নয়শীরদেশে । ততদিনে আমাদের ওষুধ শিল্পের সক্ষমতা আরও অনেক বাড়বে।
আমাদের দেশে যেসব ওষুধ উৎপাদিত হয়, তার বড় অংশই প্যাটেন্টেড নয়। এসব রেগুলার ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানিতে তাই কোনো সমস্যা থাকবে না বা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে কোনো রয়্যালটি দিতে হবে না। তাই এ বিষয়ে আশংকার কিছু নেই।
অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলেও যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকে, সে উদ্দেশ্যে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে আলোচনা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্য ঘোষণা দিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলেও তারা বাংলাদেশকে দেওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করবে না।
তবে তার পরও আমাদের বসে থাকলে চলবে না। ওষুধ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই শিল্পের গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ব্যয় বাড়াতে হবে। গড়ে তুলতে হবে প্রয়োজনীয় গবেষণাগার ও পর্যাপ্ত গবেষক।
অর্থসূচকঃ আপনাদের কোম্পানি নাভানা ফার্মা সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস দেশের দ্রুত বিকাশমান একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি। বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের অন্যতম পুরোধা প্রয়াত জহিরুল ইসলামের হাত ধরে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু শুরু। তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পদ ভাগ হয়ে গেলে-ইসলাম গ্রুপের পাশাপাশি নাভানা গ্রুপ ও আফতাব গ্রুপের জন্ম হয়। তবে নাভানা ফার্মা ইসলাম গ্রুপের অধীনেই থেকে যায়।
ইসলাম গ্রুপের একটি কোম্পানি হিসেবে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস অনেক বছর ধরেই একটি আস্থার জায়গায় ছিল। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এর ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই ধীর। এ বাস্তবতায় ২০২০ সালে কোম্পানির মালিকানায় বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন হয়। আমরা কোম্পানিটির দায়িত্ব গ্রহণ করি। তবে ইসলাম গ্রুপের কর্ণধার মঞ্জুরুল ইসলাম কোম্পানিটিতে আমাদের সাথেই আছেন।
নতুন ব্যবস্থাপনায় আসার পর কোম্পানিটিতে বেশকিছু কাঠামোগত সংস্কার করা হয়। নতুন করে কিছু দক্ষ ও যোগ্য জনবল নেওয়া হয়। এমন কিছু প্রোডাক্ট বাজারে আনা হয়, যেগুলো বাংলাদেশে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস-ই প্রথম নিয়ে এসেছে। আমরা আমাদের বিপণন ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজিয়েছি। তাতে ব্যবসায় অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত আমাদের রাজস্ব আয়ে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত পাঁচ বছর ধরে কোম্পানির নিট মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) টানা বেড়েছে।
অর্থসূচকঃ বুকবিল্ডিং পদ্ধতির আপিওতে আসছে নাভানা ফার্মা। পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা অর্থ আপনারা কোন কোন খাতে ব্যয় করবেন? এতে কোম্পানির ব্যবসা ও মুনাফায় কী প্রভাব পড়বে?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ আইপিওর মাধ্যমে আমরা পুঁজিবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করবো। এই অর্থ মূলত: কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে ২৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে নতুন কারখানা ভবন নির্মাণে, সেফালোস্ফুরিন ইউনিটের আধুনিকায়নে ব্যয় করা হবে ১৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ইউটিলিটি ভবন নির্মাণে ৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং ২১ কোটি ১৮ লাখ টাকা কোম্পানির আংশিক ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হবে।
কোম্পানির উৎপাদনক্ষমতা বাড়লে পণ্য বিক্রি এবং মুনাফাও বাড়বে। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের একাংশ পরিশোধ হলে সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয় কমবে। সব মিলিয়ে কোম্পানির নিট মুনাফা ও শেয়ার প্রতি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
অর্থসূচকঃ আইপিওকে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে কি?
প্রফেসর জোনায়েদ শফিকঃ বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য আমার সহজ বক্তব্য হচ্ছে, আমাদের উপর আস্থা রাখুন, আমরা আপনাদের আস্থার মর্যাদা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। নাভানা ফার্মা দ্রুত বিকাশমান একটি ওষুধ কোম্পানি। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পর কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণের গতি অনেক বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে আমাদের ব্যবসায় প্রতি বছর ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নাভানা ফার্মা এখন দেশের শীর্ষ ২০ ওষুধ কোম্পানির একটি। আমরা সময় উপযোগী বিজনেস পলিসি নিচ্ছি। নাভানা এমন সব ওষুধ নিয়ে আসছে, দেশে যেগুলো আমরাই প্রথম উৎপাদন করছি। রপ্তানি বাড়ানোর বিষয়েও আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা কর্পোরেট গভর্ন্যান্সের প্রতি আমরা অত্যন্ত আন্তরিক। সব মিলিয়ে বলতে পারি, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ থাকবে