চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় উন্নতি হয়েছে। একইসময়ে বেড়েছে সম্পদের পরিমাণও। আলোচ্য সময়ে তালিকাভ’ক্ত ৩৩টি ব্যাংকের মধ্যে ১৮টি ব্যাংকের মুনাফা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১৩টির। দুটি ব্যাংকের মুনাফা অপরিবর্তিত রয়েছে।
অন্যদিকে ২৫টি ব্যাংকের সম্পদ বেড়েছে এবং কমেছে সাতটির। একটির সম্পদমূল্য ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।
২০২১ সালের তুলনায় চলতি বছরে একই সময় কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মুনাফার এমন উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে আমদানি বাণিজ্য, ব্যাংকঋণের সুদ, কমিশন ও মাশুল আদায় এবং শেয়ারবাজারের মুনাফা। আলোচ্য সময়ে এসব ব্যবসা থেকে ভালো আয় করেছে ব্যাংকগুলো। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে অন্যদায়ী অনেক ঋণ নিয়মিত দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। এতেই মুনাফা বেড়েছে।
এর আগে, ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা ও করোনার আঘাতে ২০২০ সালে পরিচালন মুনাফায় ধস নেমেছিল দেশের ব্যাংক খাতে। তবে ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোর আয় খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যা অব্যাহত আছে ২০২২ সালেও।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর আয়ের বড় অংশ আসে ঋণের সুদ থেকে। তবে খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় দেখাতে পারে না ব্যাংক। করোনার কারণে গত দুই বছর ধরে ঋণ আদায় না করেও আয় দেখাতে পারছে ব্যাংকগুলো। করোনার কারণে ২০২০ সালে কেউ এক টাকা না দিলেও তাকে খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, এর ১৫ শতাংশ দিলেই নিয়মিত দেখানো হয়। আর চলতি বছর একই সুবিধা দেয়া হলেও এবার কিছু শর্ত রোগ করা হয়েছে। যেমন, বড় ঋণের ক্ষেত্রে জুনে ৫০. সেপ্টেম্বরে ৬০ ও ডিসেম্বরে ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করলে আর খেলাপি হবে না। সিএমএসএমই ও কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ২৫, ৩০ ও ৪০ শতাংশ পরিশোধ করলে কোন গ্রাহককে খেলাপি করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া এমন সুযোগও ব্যাংকগুলোর মুনাফা বাড়ার অন্যতম কারণ।
এদিকে আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পাঁচ কার্যদিবসের মাথায় গত ১৮ জুলাই ঋণখেলাপিদের জন্য বড় ধরনের ছাড় দিয়ে এক মাস্টার সার্কুলার জারি করেন। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে। আগে যা ছিল ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব ঋণ পরিশোধ করা যাবে ৫ থেকে ৮ বছরে। আগে এ ধরনের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
নানা সমালোচনার মুখে গত ৪ আগস্ট এক নির্দেশনা জারি করে খেলাপি ঋণে ছাড় কমায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওইদিন জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুনঃতফসিলের পর আরোপিত সুদ প্রকৃত আদায় ছাড়া ব্যাংকের আয় খাতে স্থানান্তর করা যাবে না। মন্দ মানে শ্রেণিকৃত ঋণ তৃতীয় ও চতুর্থবার পুনঃতফসিল করার ক্ষেত্রে প্রকৃত আদায় ছাড়া সংরক্ষিত প্রভিশন ব্যাংকের আয় খাতে নেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা আসার আগেই চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো। ফলে জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদনে আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে দেখানোর সুযোগ ছিল।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ পরিশোধে নীতি ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকেরই আদায় কমেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ছাড়ের কারণে বেশকিছু ব্যাংকে অনাদায়ী সুদও আয়ের খাতে নিয়ে আসায় মুনাফা বেশি দেখাচ্ছে। পরিচালন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি আমানতের সুদহার সর্বনিম্নে নামিয়ে আনার সুফলও পেয়েছে ব্যাংকগুলো। আমদানি, রফতানি, রেমিট্যান্সের কমিশন থেকে প্রাপ্ত আয় ও পুঁজিবাজার থেকে পাওয়া মুনাফার প্রভাব বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফায় প্রতিফলিত হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে ব্যাংকের মুনাফায় উল্লম্ফন হলেও দীর্ঘমেয়াদে দেশের ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ছাড় দেওয়ার কারণে কোনো কোনো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার পরও নিয়মিত করে রেখেছে। আবার আদায় ছাড়া পুনঃতফসিল করা ঋণের সুদ দেখিয়েছে আয় খাতে। সুযোগ পেয়ে অনেকে প্রয়োজনীয় প্রভিশন করেনি। এতে মুনাফা বেড়ে গেছে কিছু কিছু ব্যাংকের। আবার যারা যথাযথভাবে প্রভিশন করেছে তাদের মুনাফা কম হয়েছে। তবে এই মুনাফা ভবিষ্যতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে দেশের ব্যাংকখাতে।
এই প্রসঙ্গে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি সেলিম আর এফ হোসেন অর্থসূচককে বলেছেন, ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে, এটা ঠিক নয়। কেননা ২০২১ সালে দেশে করোনার ভয়াবহতা বিরাজ করেছে। এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তায় বেশকিছু ছাড় দিয়েছে। ২০২০ সালে পরিশোধ না করলেও কোন ঋণই খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে ২৫ শতাংশ পরিশোধে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয়া হয়। এসব ছাড়ের ফলে অধিকাংশ ব্যাংকই প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি। এর ফলে আগামী বছরে এসব ব্যাংক ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মুনাফা ব্যাংকের জন্য বড় বিষয় নয়। এখন সময় হলো সম্পদের গুণগত মান ঠিক রেখে মূলধনের ভিত শক্তিশালী রাখা। ব্যাংক কখনই স্বল্পমেয়াদি কোনো ব্যবসা নয়। গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রেখে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকাই যে কোনো ব্যাংকের বড় সফলতা।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতি তিন মাস পর পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ৩৩টি ব্যাংক চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ১৮টির মুনাফা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১৩টির। দুটি ব্যাংকের মুনাফা অপরিবর্তিত রয়েছে। অন্যদিকে ২৫টি ব্যাংকের সম্পদ বেড়েছে এবং কমেছে সাতটির। একটির সম্পদমূল্য ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় নিমজ্জিত আইসিবি ইসলামী ব্যাংক এবার মুনাফার খাতায় নাম লিখিয়েছে। ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২ পয়সা। আগের বছর একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৩২ পয়সা। মুনাফার দেখা পেলেও ব্যাংকটির সম্পদমূল্য এখনো ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৮ টাকা ১২ পয়সা।
বরাবরের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি মুনাফা করেছে ডাচ-বাংলা ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩ টাকা ৫৮ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩ টাকা ২৫ পয়সা। সে হিসাবে শেয়ারপ্রতি মুনাফা বেড়েছে ২৩ পয়সা। মুনাফার পাশাপাশি ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকা ৯ পয়সা, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৫৩ টাকা ১৩ পয়সা।
বড় মুনাফার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যমুনা ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৩ টাকা ৪ পয়সা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২ টাকা ৬৪ পয়সা। মুনাফা বাড়লেও কোম্পানিটির সম্পদের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৮ টাকা ২৩ পয়সা, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২৮ টাকা ৪১ পয়সা।
চলতি বছর মুনাফায় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের। এই প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা গত বছরের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। এতে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ৪৯ পয়সা থেকে বেড়ে ৮৭ পয়সা হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সম্পদের পরিমাণ। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদ দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ৮১ পয়সা, যা গত বছর ছিল ১৭ টাকা ৬৫ পয়সা।
অধিকাংশ ব্যাংকের মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হলেও ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, আইএফআইসি, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি), ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ইউসিবি এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা গত বছরের তুলনায় কমেছে।
এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এ ব্যাংকটি চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি লোকসান গুনেছে ৫৪ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি ২৮ পয়সা মুনাফা হয়। মুনাফার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ কমে গেছে। একই সঙ্গে ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে ক্যাশ ফ্লো। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৪৯ পয়সা, যা গত বছর ছিল ১৭ টাকা ২৯ পয়সা। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৪ টাকা ৭৯ পয়সা।
শতকরা হিসাবে গত বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মুনাফা কমেছে আইএফআইসি ব্যাংকের। এ ব্যাংকটির মুনাফা ৪০ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৫২ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৭ পয়সা। মুনাফা কমার পাশাপাশি ব্যাংকটির ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক অবস্থায় রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ টাকা ৭০ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো ছিল ৪ টাকা ৫৭ পয়সা।
এর পরের স্থানে রয়েছে ওয়ান ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই ব্যাংকটি শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ৯৮ পয়সা। গত বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয় ১ টাকা ৪৬ পয়সা। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় ব্যাংকটির মুনাফা কমেছে ৩৩ শতাংশ। মুনাফা কমলেও সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৯ টাকা ৬৮ পয়সা, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ১৮ টাকা ৯৬ পয়সা।
এদিকে এনসিসি ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের মুনাফায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। গত বছরের মতো চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ে এনসিসি ব্যাংক শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। মুনাফায় পরিবর্তন না এলেও ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৩ টাকা ২৫ পয়সা, যা গত বছর ছিল ২১ টাকা ৯৫ পয়সা।
সাউথইস্ট ব্যাংক চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে ২ টাকা ৫৬ পয়সা। মুনাফায় পরিবর্তন না এলেও ব্যাংকটির সম্পদমূল্য গত বছরের তুলনায় কমেছে। চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ২৬ টাকা ৮৮ পয়সা, যা গত বছর ছিল ২৭ টাকা ৯৭ পয়সা।