পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এবি ব্যাংকের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর পেটে। কোন রকম নিয়মনীতি না মেনে উদারভাবে ঋণ দিয়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকটি। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের দুই ভাই, তিন ভাতিজা, ভাগনেসহ আরও অনেকের নাম ব্যবহার করেছেন তিনি। এমনকি নিউইয়র্কে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে তাঁকে ডলারে ঋণও দিয়েছে ব্যাংকটি।
সব মিলিয়ে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির উদ্যোক্তাদের ‘নির্দেশে’ দেওয়া এসব ঋণ বছরের পর বছর আদায়ও হচ্ছে না। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে জানা গেছে। আর এবি ব্যাংক টাকার জন্য ঘুরছে তাঁর আত্মীয়দের পেছনে।
এবি ব্যাংকের অন্যতম উদ্যোক্তা বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, এখনো ব্যাংকটি তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের মনোনীত পরিচালকেরাই ব্যাংকটির পর্ষদে রয়েছেন। দীর্ঘ সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন ওয়াহিদুল হক, তিনি মোরশেদ খানের চা-বাগানের পরিচালক। এবি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর আছে নানা পরিচয়। কখনো তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লোক, কখনো কোনো বাহিনী বা দুর্নীতি দমন কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ের কারও কাছের। আবার কখনো মোরশেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোরশেদ খানের ঘনিষ্ঠ। এর ফলে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নামে টাকা বের করতে কখনোই কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি।
এবি ব্যাংকের মূলধন ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। সে হিসাবে একজন গ্রাহককে ব্যাংকটির মূলধনের ২৫ শতাংশ হিসেবে ৮৩৮ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। তবে মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর মতো একজন ঠিকাদারকে সীমার দ্বিগুণ ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে ব্যাংকটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানসমূহ আলাদা নামে হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টাকার অবাধ লেনদেন হয়েছে। যারা সবাই মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর আত্মীয়। কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াই এসব লেনদেন হয়েছে। আবার যে উদ্দেশ্যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা-ও মানা হয়নি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান একই গ্রুপের না হলেও সবাই সবার ঋণের সুবিধাভোগী।
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারিক আফজাল এ নিয়ে বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক ও এমডি মশিউর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে এত ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ঋণ অনিয়মের ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাননি তিনি।
সাবেক এমডি মশিউর রহমান বর্তমানে পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। তিনি এমডি হওয়ার আগে ব্যাংকটির ঋণ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটায় মশিউর রহমান টেলিফোনে বলেন, ‘শাখা পর্যায় থেকে ঋণ প্রস্তাব এসেছে। যাচাই-বাছাই করে পর্ষদ অনুমোদন করেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত মিঠুর সব ঋণ ভালো ছিল। ব্যাংক যখন সমস্যায় পড়েছে, তখন বড় অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে ব্যাংককে উদ্ধার করেছেন মিঠু। এরপর ব্যাংক থেকে তাঁকে সহায়তা দেওয়া হয়নি।’ একজন ব্যক্তিকে কীভাবে এত ঋণ দেওয়া হলো—এ নিয়ে মশিউর রহমান বলেন, ‘এ জন্য মিঠু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান অন্য নামে করেছেন। আইন অনুযায়ী তাঁর ঋণ বেশি নয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের প্রধান শাখার গ্রাহক ছিলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠু। ওই শাখায় লেক্সিকন মার্চেন্ডাইজারের স্বত্বাধিকারী ও অ্যাপল সিরামিক লিমিটেডের পরিচালক ছিলেন তিনি। এক ভাগনে ফাহাদ মাহমুদের নামে আর্ডেন্ট সিস্টেম ও আরেক ভাগনে বেনজির আহমেদের নামে হেভ ইন্টারন্যাশনাল নামে কোম্পানি খুলে টাকা নিয়েছেন। অফশোর ইউনিট থেকে টাকা বের করতে ভাতিজা আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরীর নামে নিউইয়র্কে খোলা হয় স্টারলিং ডায়াগনস্টিক লিমিটেড লায়াবিলিটি কোম্পানি।
তাঁর বড় ভাই মোকসেদুল ইসলাম থ্রি আই মার্চেন্ডাইস ও ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের নামে ঋণ নিয়েছেন। আরেক ভাই কামরুল হক চামড়া খাতের কোম্পানি খুলে টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া নর্থ এগ লিমিটেড ও একটি ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানের নামেও ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাংকের প্রধান শাখা ও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা, যা এখন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোতাজ্জেরুল ইসলামের আত্মীয়দের ঋণ না দেওয়ার পরামর্শ দিলেও কামরুল হকের ভাই ভাই লেদারকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ দেয় এবি ব্যাংক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্টারলিং ডায়াগনস্টিক নিউইয়র্কে একটি একক মালিকানাধীন কোম্পানি। ২০১৬ সালের ১৩ জুন আমেরিকার করপোরেশন অ্যান্ড স্টেট রেকর্ড বিভাগ থেকে নিবন্ধন নেয় প্রতিষ্ঠানটি, যার নম্বর ৪৯৬১৯৬১। এর মালিক আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী, তিনি মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর ভাতিজা। প্রতিষ্ঠানটিকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ৫ বছর মেয়াদি ৪২ লাখ ডলার ঋণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৩৫ কোটি টাকা। এই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকটি কোনো রূপ বিচার-বিশ্লেষণে করেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত অর্থ পাচারের ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশের ২১ ব্যক্তির মধ্যে ছিলেন এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম ও তাঁর ভাই মোকসেদুল ইসলাম। দুজনকেই অর্থ দিয়েছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে আমরা ওনার সব ঋণ নিয়মিত করেছি। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি জমাও দিয়েছেন। চেষ্টা করছি ঋণ আদায় করার। এখন তো কিছু করার নেই, ঋণ অনেক আগে দেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গ্রাহকের সঙ্গে ব্যাংক যোগাযোগ করতে পারছে না, এটি কি সত্য—এর জবাবে মাহমুদুল আলম বলেন, ‘উনি তো আমেরিকায় থাকেন। তাই অনেক দিন যোগাযোগ করা যায়নি। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানের অন্যদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। টাকা আদায়ের চেষ্টা চলছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মোতাজ্জেরুল ইসলামের ঋণ নিয়ে বলছে, পুরো ঋণের অর্থ অন্যত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যবসায় অর্থ ব্যবহার করা হয়নি। অন্যদিকে ঋণগ্রহীতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যাংক তাঁকে পায়নি। এই অবস্থায় ঋণটি আদায়ের সম্ভাবনা নেই। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এমন কার্যকলাপ সুশাসন ও ঋণশৃঙ্খলা পরিপন্থী, যা একটি গুরুতর অপরাধ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, একটি ব্যাংক ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এমন দু-একজন গ্রাহকই যথেষ্ট। মালিকপক্ষের যোগসাজশ ছাড়া এসব গ্রাহক ঋণ পান না। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এত সাহস নেই যে একজনকে দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়ে দেবে। তাই বিষয়টি পুরোপুরি তদন্ত করে মিঠুকে দেশে ফিরিয়ে এনে টাকা উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।