জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল স্বাধীন দেশের ৫১তম বাজেট উপস্থপন করবেন বৃহস্পতিবার (৯ জুন)। এটা অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুস্তফা কামালের ৪র্থ বাজেট।
এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার হতে পারে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চলমান বাজেট অধিবেশনে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদ সভায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হবে। মন্ত্রী পরিষদ সভায় নতুন বাজেট অনুমোদনের পর, রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দেওয়ার পর তা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে।
সাধারণত, ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত একটি অর্থবছর ধরা হয়। সরকারের আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব সংবলিত এই বাজেটে থাকে অনেক হিসাব নিকাশ। সে হিসেবে আগামী ৩০ জুন ২০২১-২০২২ অর্থবছর শেষ হবে এবং ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছর অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ অর্থবছর শুরু হবে।
বাজেটে সাধারণত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থার তৈরিতে সরকারের পরিকল্পনা প্রতিফলিত হয়। আগামী অর্থ বছরে সরকার কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার এবং গুরুত্ব দিচ্ছে বাজেটে তারই আভাস পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, কোভিড পরবর্তী সময়ে দেশে কর্মসংস্থার সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার এবার বাজেটে উন্নয়ন এবং বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালি করতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এবারের বাজেটের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে সহযোগিতা করা। এসব বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে এবারের বাজেটের শ্লোগান ‘কোভিডের বিপর্যয় জয় করে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা’।
এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হবে বলে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি করোনা পরবর্তী বিরাজমান বৈশ্বিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেটা কারো পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে দেশের মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকবে নতুন বাজেটে।
নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত দুটি বছর বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। কোভিড প্রতিরোধে টিকাদান কর্মসূচি, বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা এবং নীতিগত সহযোগিতার মাধ্যমে গত দুই বছর কোভিডের বিরুদ্ধে সরকার সফলতার সঙ্গে জনগণ এবং ব্যবসা বাণিজ্যকে রক্ষা করতে পেরেছে। নতুন বাজেটে দেশি-বিদেশি আরও বিনিয়োগ ব্যবস্থা এবং রাজস্ব আদায় ও জনগণের জন্য কর্মসংস্থার সৃষ্টির লক্ষ্যে নীতিগত উদ্যোগ নেওয়ার সময়। এসব বিষয় বাজেটে গুরুত্ব পাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট জিডিপির ২০ শতাংশ বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে সরকার প্রক্ষেপণ করছে।
বাজেটে বাংলাদেশের মোট বিনিয়োগ প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। বতর্মানে এর পরিমাণ হচ্ছে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ হচ্ছে ২১ দশমিক ১৮ শতাংশ। জিডিপির প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সঙ্গে নতুন অর্থছরের মূল্যস্ফীতি প্রক্ষেপন করা হচ্ছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকারের অনুমোদিত ১০০ বছরের ডেল্টা পরিকল্পনা হবে তথ্য প্রযুক্তি এবং জ্ঞান নির্ভর ‘টেকনো-ইকনোমিক মাস্টার প্ল্যান’। ধাপ ভিত্তিতে এর বাস্তবায়ন করতে দেশের মানুষের জন্য আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপির পরিমাণ ২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকছে নতুন বাজেটে।
বেকারত্ব এখনো দেশের জন্য একটি প্রধান সমস্যা। গেল এক দশকে বাংলাদেশ বেশ সন্তোষজনক জিডিপি অর্জন করেছে। কিন্তু বেকারত্বের হার এখনো সেই একই রকম রয়েছে। ২০১৩ এবং ২০১৬-২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জড়িপে দেখা যায় বেকারত্বের হার হচ্ছে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৩ এবং ৪ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৬-২০১৭ সালে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ (৫৮ দশমিক ১ মিলিয়ন থেকে ৬০ দশমিক ৮ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে,প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি নিয়ে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের খসড়া প্রস্তাব করা হবে। নতুন এই বাজেটের আকার সম্ভাব্য আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা কি না চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের চেয়ে এটি ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি বা ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি।
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট নির্ধারণ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেটটি উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে তাতে ঘাটতিই থাকবে দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসাবে যা সাড়ে ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। যা জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ হলেও সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ।
নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হবে ব্যাংকিং খাতের ওপর। এই খাত থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়া হবে ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। এবার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ করার কারণে বেসরকারি খাত বিনিয়োগের জন্য ঋণ বঞ্চিত হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরের ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের মধ্যে শুধু সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট ঋণ নেওয়া হবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। আর ঋণ পরিশোধে ব্যয় করা হবে ১৭৮ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য মোট কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল তিন লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। মোট কর রাজস্বের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদায় করা হবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে আদায় করা হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং কর ছাড়া প্রাপ্তি থেকে আদায় লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এনবিআর খাতে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য নির্ধারিত রয়েছে তিন লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তিন হাজার ২৭১ কোটি টাকা বিদেশী অনুদান পাওয়া যাবে বলে বাজেটে উল্লেখ থাকছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সুদ দিতেই ব্যয় করতে হবে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এই সুদের মধ্যে আবার দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় হবে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ গুনতে হবে ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয়ের জন্য ধরা রয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
বাজেটের বড় একটি দিক হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আগামী অর্থবছরের জন্য এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ২ লাখ ৯ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরে জন্য জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার সম্ভাবনা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছন।