দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে প্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগে আনতে চায় সরকার। তাই আগের বছরের ধারাবাহিকতায় গত বছরের বাজেটেও পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে প্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়।
আগামী অর্থবছরের বাজেটেও পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে। পূর্বের নিয়মে নিয়মিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে প্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ করতে হবে।
পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে টাকা বিনিয়োগ করলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না- এ মর্মে আয়কর অধ্যাদেশেও সংশোধনী আনা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের মূলধারার অর্থনীতিতে প্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা আনতে চলতি বাজেটে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজার বা আবাসন খাতে বিনিয়োগ দেয়া হয়। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ সুযোগের মেয়াদ না বাড়ানোয় আইনগতভাবে তা বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
প্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ সুযোগ বাতিল করার কারণ হচ্ছে- দেশে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ কর হার ২৫ শতাংশ। এ সুযোগ অব্যাহত রাখা হলে করদাতারা নিয়মিত কর না দিয়ে তা লুকিয়ে রেখে পরে ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে টাকা বৈধ করার চেষ্টা করতে পারেন। এতে রাজস্ব আদায় কমার পাশাপাশি সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতকে চাঙা করতে কালো টাকা বিনিয়োগের নতুন বিধান করা হচ্ছে। এ দুই খাতে কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে করদাতা যে হারে কর দেবেন, তাকে এর অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। এতে দুদক বা অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না।
চলতি বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন দুটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। ১৯এএএএ ধারায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্টক, শেয়ার, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার ও অন্য সিকিউরিটিজ এবং পুঁজিবাজারে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য সব সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে এ সুযোগ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে বিশেষ সুবিধা বাতিল হচ্ছে। কিন্তু আগের ৩ পদ্ধতিতে টাকা সাদা করা যাবে। এ জন্য কোনো সংস্থা যাতে আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইতে না পারে সে জন্য আয়কর অধ্যাদেশে প্রভিশন রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালোটাকা পুঁজিবাজার বা আবাসন খাতে বিনিয়োগ করলে কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না।
এক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়, ঘোষণা দেওয়ার পর এক বছর বিনিয়োগকৃত অর্থ পুঁজিবাজার থেকে ওঠানো যাবে না। একইভাবে একই হারে কর দিয়ে ১৯এএএএএ ধারায় জমি-ফ্ল্যাট ও নগদ অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। ১০ শতাংশ কর দিয়ে টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় একে ‘বিশেষ সুবিধা’ বলা হচ্ছে।
এর বাইরেও আরও ৩ পদ্ধতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ (কালোটাকা সাদা) করা যায়। আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) ধারা অনুযায়ী, নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ জরিমানা দিয়ে যে কোনো খাতেই কালোটাকা বিনিয়োগ করা যায়। শুধু আবাসন খাতের জন্য ১৯বিবিবিবিবি নামে আয়কর অধ্যাদেশে আলাদা একটি ধারা আছে।
এ ধারা অনুযায়ী, এলাকাভিত্তিক নির্ধারিত হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা যায়। ১৯ডিডি ধারা অনুযায়ী, ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করা যায়।
কালো টাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের একাংশ এর বিরোধিতা করে আসছে। ’৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে।
তৎকালীন সময়ে এ থেকে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ’৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ’৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ’৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা।
দেশে এরপর ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১৯৯৭-২০০০ পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১-০৭ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূল ধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা।