দেশের শেয়ারবাজারে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণে গত বছরের প্রথমার্ধ সূচক ও লেনদেনের নিম্নমুখিতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়ায় পুঁজিবাজার। আর এ চাঙ্গা ভাব বজায় ছিল এ বছরেও। তবে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই আবারো পুঁজিবাজারে ছন্দপতন ঘটে। সূচকের পয়েন্ট হারানোর পাশাপাশি এ সময় পুঁজিবাজারে লেনদেন আড়াই হাজার কোটি টাকা থেকে আটশ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত বছরের ১৮ মার্চ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রড ইনডেক্স ডিএসইএক্স ৩ হাজার ৬০৪ পয়েন্টে নেমে গিয়েছিল। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটির কারণে ৬৬ দিন বন্ধ ছিল পুঁজিবাজারের লেনদেন। ৩১ মে থেকে লেনদেন আবার চালু হলেও প্রথমে সূচক ও লেনদেনে তেমন একটা গতি আসেনি। তবে গত বছরের আগস্ট থেকেই গতি ফিরতে শুরু করে দেশের পুঁজিবাজারে। এ সময় সূচকের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় লেনদেন। গত বছরের ৩ আগস্ট ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ২৭১ পয়েন্টে। সেখান থেকে এ বছরের ১৪ জানুয়ারি সূচকটি ১ হাজার ৬৩৭ পয়েন্ট বেড়ে ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে দাঁড়ায়। অবশ্য এর পর থেকেই পুঁজিবাজারে নিম্নমুখিতা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গত দুই কার্যদিবসে ২৭১ পয়েন্ট হারিয়েছে ডিএসইএক্স।
সোমবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি), বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকো লিমিটেড ও গ্রামীণফোনের শেয়ার। এই চার কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের প্রভাবে সূচক কমেছে ৫৭ পয়েন্ট। ডিএসইএক্সের পাশাপাশি সোমবার শরিয়াহ্ সূচক ডিএসইএস ২০ পয়েন্ট এবং নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএসই-৩০ কমেছে ৬৭ পয়েন্ট। গতকাল পুঁজিবাজারে ৭৮৯ কোটি টাকার সিকিউরিটিজ লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ২৩টির, কমেছে ২৩৬টির আর অপরিবর্তিত ছিল ৯১টির বাজারদর।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক মাসের উত্থানের কারণে অনেক বিনিয়োগকারীর মধ্যে বর্তমানে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয়া এবং ৬৬ দিন লেনদেন বন্ধ থাকার কারণে অনেক বিদেশী বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। কিন্তু গত কয়েক মাসের উত্থানের কারণে দেশী-বিদেশী সব শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ারের দর বেড়েছে। ফলে অনেকেই মুনাফা তুলে নিতে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি থাকার প্রভাবে সূচক পয়েন্ট হারাচ্ছে। তাছাড়া যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলছেন তারা এখনই আবার পুনর্বিনিয়োগ না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এ কারণে বর্তমানে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণও কমে গেছে। শেয়ারের মূল্য আরো কমে গেলে তারা নতুন করে বিনিয়োগে ফিরে আসবেন। পাশাপাশি আগের তুলনায় বর্তমানে কম মার্জিন ঋণ পাওয়ার কারণেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে।
বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (০৮ ফেব্রুয়ারি) পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) নেতাদের একটি অনলাইন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের বিষয়ে ডিবিএর প্রেসিডেন্ট শরীফ আনোয়ার হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও যথাযথভাবে সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম যাতে অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছি। একই সঙ্গে কোনো ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে যাতে বাজারের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি ব্যাহত না হয়, সেটিও আমাদের প্রত্যাশা। আর সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবাই যাতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যৌক্তির আচরণ করে, সেটিই আমাদের কাম্য।
এদিকে, সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে এ খাত থেকে বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে এবং তারা বিনিয়োগেও আগ্রহী হচ্ছে না। পাশাপাশি কভিডের কারণে নতুন করে বেসরকারি খাতে সেভাবে বিনিয়োগও করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে বড় অংকের বিনিয়োগযোগ্য অলস অর্থ জমা হয়ে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা অলস অর্থের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষায় গত বছর ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। হাতে বড় অংকের অলস অর্থ থাকা সত্ত্বেও হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বেশির ভাগ ব্যাংকই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না। এতে কোনো কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ বেড়ে গেলে সেটিকে প্রশমিত করে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগানে ব্যাঘাত ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিনিয়োগকারীরা এখন যদি পেনিক সেল করে, তাহলে প্রকারান্তরে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বাজার এক সময়ে ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে। তখন তাদেরকে বিক্রি করা শেয়ার বেশি দরে কিনতে হবে।