দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৩৪ মাস আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। শেয়ারবাজারের প্রধান এ সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে আসায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে ভীতি ছড়িয়েছে। তাতে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমে গেছে। লেনদেনও নেমে এসেছে ৫০০ কোটি টাকার নিচে। ফলে বাজারে ফোর্সড সেল বা জোরপূর্বক বিক্রির আতঙ্ক বেড়েছে।
ডিএসইএক্সের ৬ হাজার পয়েন্টের বিষয়টি একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমা, যাকে বাজারের একটি মাইলফলক হিসেবে অনেকে বিবেচনা করে থাকেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকটি গতকাল বুধবার ৩৩ পয়েন্ট কমে ৫ হাজার ৯৭৪ পয়েন্টে নেমে আসে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৫ মে ডিএসইএক্স সূচক এর চেয়েও নিচে ৫ হাজার ৮৮৫ পয়েন্টে নেমে এসেছিল। ২০২০ সালে মহামারির কারণে লম্বা সময় শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। আর এ বন্ধের মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্ব বদল হয়। অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত বিএসইসি ২০২০ জুনে আবার লেনদেন চালু করে। ২০২১ সালের শেষভাগে এসে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং ডিএসইএক্স সূচকটি ৭ হাজারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের শেষভাগে শেয়ারবাজারে কিছুটা গতি ফিরলেও ২০২২ সালের শুরু থেকে বাজার আবার পড়তে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের কিছুটা নিচে নেমে আসে। বাজারের পতন ঠেকাতে তখন শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি। এ কারণে ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর প্রায় ২০ মাস সূচক আর ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামেনি। তবে বাজার স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ, ফ্লোর প্রাইস আরোপের ফলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারই লেনদেন হতো না। এ অবস্থায় ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। এরপর একপর্যায়ে সূচকটি বেড়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে উঠেছিল। গতকাল যা কমে আবার ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমেছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজারে প্রধান সূচকের ৬ হাজার পয়েন্ট একধরনের মনস্তাত্ত্বিক সীমা হয়ে উঠেছে। তাই যখন সূচক ৬ হাজারের কাছাকাছি বা নিচে নেমে আসে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করে। এ কারণে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছে না, উল্টো অনেকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে বসে আছেন।
এদিকে একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এরই মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ফোর্সড সেল শুরু করেছে। ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের দাম যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে যায়, তখন ঋণের টাকা উদ্ধারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করে দেন। এটি শেয়ারবাজারে ফোর্সড সেল হিসেবে পরিচিত।
ঢাকার বাজারে গতকাল দেখা গেছে, লেনদেন ও মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও মাঝারি মানের কোম্পানিগুলো। তার বিপরীতে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের দরপতন হয়েছে। ডিএসইতে এদিন মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষ পাঁচ কোম্পানি ছিল লাভেলো, ফু-ওয়াং সিরামিক, গোল্ডেন সন, রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স এবং এসএস স্টিল। এর মধ্যে লাভেলো ও রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স ছাড়া অন্য তিনটি কোম্পানি ২০২৩ সালে ২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি। তার বিপরীতে এদিন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোন, বেক্সিমকো ফার্মার মতো কোম্পানির শেয়ারের দরপতন হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরপতনে মৌলভিত্তির অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। তাতে এসব শেয়ারের দাম এখন অবমূল্যায়িত পর্যায়ে চলে এসেছে। কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করবে। সেটি হলে বাজার দ্রুতই ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছি।’
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে শেয়ারবাজার কিছু বাজে কোম্পানিনির্ভর হয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে না। এর বিপরীতে বাজে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। তাই তাঁরা অনেকটাই বাজারবিমুখ হয়ে পড়েছেন। এ কারণে গতকাল দিন শেষে ডিএসইতে লেনদেন কমে ৪৮৩ কোটি টাকায় নেমেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজার যেখানে চলে গেছে, তাতে ভালো শেয়ার কিনলেই এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের আগ্রহও হারিয়ে ফেলছি, নতুন বিনিয়োগেরও সাহস হচ্ছে না।’