লেনদেনের শুরুতেই গতকাল কারিগরি ত্রুটির মুখে পড়ে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইট। তাতে লেনদেনের তথ্য দেখালেও সূচক ওঠানামায় দেখা দেয় বিভ্রান্তি। কখনো ডিএসইর সার্বিক সূচক ছয় হাজার পয়েন্ট হারানোর তথ্য দেখায় তো আবার কখনো তা ছিল একেবারেই স্থির। দিনভর এ পরিসংখ্যান বিভ্রাটের কারণে সংশয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। সঠিক তথ্য না পাওয়ায় অনেকেই ছিলেন বাজারবিমুখ। শেষ পর্যন্ত গতকাল রাতে এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে আজ সকালে লেনদেন শুরুর আগে সবকিছু আবারো পরীক্ষা করে দেখা হবে বলেও জানায় এক্সচেঞ্জটি।
অন্যান্য দিনের মতোই গতকাল সকাল ১০টায় ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয়। এর পরই সামনে আসে সার্বিক সূচক ডিএসইএক্স ও শরিয়াহ সূচক ডিএসইএসের বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান। সকাল ১০টা ১৬ মিনিটে ডিএসইএক্স সূচক প্রদর্শন হয় দশমিক ৩৯ পয়েন্টে। সে হিসেবে ডিএসইএক্স কমে ৬ হাজার ১১২ পয়েন্ট, শতাংশের হিসাবে যা প্রায় শতভাগ। একইভাবে ডিএসইর শরিয়াহ সূচকও প্রায় ১০০ শতাংশ কমে দশমিক শূন্য ৪ পয়েন্টে দাঁড়ায়। বেলা ১১টার দিকে আবার ডিএসইর সব সূচকের পরিবর্তনের ঘরে শূন্য দেখায়। তার মানে লেনদেন শুরুর পর থেকে সূচকের কোনো ওঠানামাই হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। পরে বেলা ১টার দিকে সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে ডিএসইর পক্ষ থেকে জানানো হয়। ওই সময় ডিএসইএক্স ছিল ৬ হাজার ১১৩ পয়েন্টে। তবে এর কিছুক্ষণ পর আবারো বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান দেখায় ডিএসইর ওয়েবসাইট। শেষ পর্যন্ত গতকাল বেলা আড়াইটায় লেনদেন শেষ হওয়ার পর ডিএসইএক্স সূচকের অবস্থান ছিল ১৪১ দশমিক ৫৭ পয়েন্টে। সে হিসাবে একদিনে সূচকটি হারিয়েছে ৫ হাজার ৯৭১ পয়েন্ট বা ৯৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। যদিও সার্কিট ব্রেকার থাকায় একদিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি সূচকের পতন হওয়া সম্ভব নয়।
ওয়েবসাইটে কারিগরি ত্রুটির কারণ হিসেবে ডিএসইর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি আমরা নেটওয়ার্কস লিমিটেডের শেয়ার রেকর্ড ডেট শেষে লেনদেনে ফেরার কথা ছিল গতকাল। রাইট শেয়ারসংক্রান্ত রেকর্ড ডেটের কারণে গত বৃহস্পতিবার কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন বন্ধ ছিল। সাধারণ নিয়ম অনুসারে রেকর্ড ডেট শেষে যেদিন কোম্পানির লেনদেন চালু হয় সেদিন এর দর সমন্বয় হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আমরা নেটওয়ার্কসের শেয়ারের ক্ষেত্রেও দর সমন্বয়ের কথা ছিল, যা ম্যানুয়ালি সফটওয়্যারের মাধ্যমে করতে হয়। সেটি করতে গিয়েই জটিলতা তৈরি হয়। সার্বিকভাবে ডিএসইর সূচকে বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান দেখাতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আমরা নেটওয়ার্কসের শেয়ার লেনদেন স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি গতকাল কোম্পানিটির যেসব শেয়ার লেনদেন হয়েছে, সেগুলোও বাতিল করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সংশোধনীমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পর আজ থেকে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন শুরু হবে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সূচকের বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যানের কারণে গতকাল পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারীই বাজারবিমুখ ছিলেন। এ কারণে গতকাল পুঁজিবাজারে মাত্র ৪৭৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক আবু আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজারের উত্থান-পতন সম্পর্কে গতকাল সকাল থেকেই কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। এককভাবে বিভিন্ন শেয়ারের তথ্য দেখে সবাই কিছুটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে বাজার সম্পর্কে সবাই একপ্রকার অন্ধকারেই ছিল বলা যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ডিএসইর তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে। এটিকে তাদের ব্যর্থতা বলতে হবে। এর সঙ্গে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ডিএসইর পর্ষদকে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিকেও এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে।’
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল এক্সচেঞ্জটির উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। এছাড়া বিএসইসির অন্যান্য কমিশনারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই অনুষ্ঠান চলাকালীন ওয়েবসাইটে বিভ্রান্তির বিষয়টি নিয়ে ডিএসইর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান। তবে কারিগরি এ ত্রুটির বিষয়টি সমাধানের জন্য দিনভর ডিএসইর কর্মকর্তারা চেষ্টা চালান। কিন্তু কোনো কার্যকর ফল আসেনি।
ডিএসইতে তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত ইস্যুতে বার বার সমস্যা তৈরির বিষয়টিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি পরিদর্শক দল গঠন করে দিয়েছি। তারা এর কারণ খুঁজে বের করবে।’
ডিএসইর ওয়েবসাইটে সূচকের পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তিকর তথ্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিএসইসির পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সমন্বয়ে দুই সদস্যবিশিষ্ট পরিদর্শক দল গঠন করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত আদেশে বলা হয়েছে, ডিএসইতে লেনদেনের শুরু থেকে সূচকের অস্বাভাবিক সংখ্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। পুঁজিবাজারের উন্নয়ন ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আলোচ্য ঘটনাসহ ডিএসইর তথ্যপ্রযুক্তি ও সূচক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের ওপর পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এ আদেশ জারির তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে পরিদর্শন সম্পন্ন করে কমিশনের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পরিদর্শক দলের সদস্যরা গতকালই ডিএসইতে গিয়ে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ওপর পুঁজিবাজারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। আমরা সবসময়ই এক্সচেঞ্জগুলোকে প্রণোদিত করেছি, যাতে তারা সে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা সেটি অর্জনের দিকে যেতে পারেনি। এ ধরনের তুচ্ছ ও ছোটখাটো সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশীদের ওপর নির্ভরতা পরিহার করতে হবে। নিজেরাই যাতে এ সমস্যা সমাধান করতে পারে, এক্সচেঞ্জকে সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আমরা চাই ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কোনো ঘটনার কারণে বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম কোনো সমস্যার মধ্যে পড়তে না হয়।’
এদিকে ডিএসইর পক্ষ থেকেও তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে প্রধান করা হয়েছে এক্সচেঞ্জের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) এজিএম সাত্বিক আহমেদ শাহকে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এ প্রতিবেদন লেখার সময় অবশ্য ত্রুটি সারিয়ে গতকালের লেনদেনের ভিত্তিতে সূচকের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে ডিএসই। এতে দেখা যায়, গতকাল ডিএসইএক্স ৩৭ দশমিক ৫২ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ৭৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস প্রায় ১১ পয়েন্ট হারিয়ে ১ হাজার ৩২৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। আর নির্বাচিত কোম্পানির সূচক ডিএস-৩০ গতকাল ১০ দশমিক ৪৮ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮৪ পয়েন্টে। সমস্যার সমাধান হওয়ায় আজ পুঁজিবাজারে নির্বিঘ্নে লেনদেন চালুর বিষয়ে আশাবাদী ডিএসই। তবে সতর্কতার অংশ হিসেবে আজ সকালে লেনদেন চালুর আগে সবকিছু ঠিক আছে কিনা সেটি পুনরায় পরীক্ষা করে দেখবেন এক্সচেঞ্জটির কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. এটিএম তারিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কী কারণে এ ধরনের সমস্যা হয়েছে এবং এর সমাধান কী সেটি খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গতকাল রাতে নাসডাকের সঙ্গে মিলে সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তবে আজ সকালে লেনদেন শুরুর আগে এটি পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা হবে কোনো সমস্যা কিংবা জটিলতা রয়েছে কিনা?’